বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত ভয়ানক ব্যাপার। তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলা হলো এতে দেশের জনগণ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। রেডিও তেহরানের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, সালাহউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং মানবাধিকারের লংঘন। বর্তমান সরকারের যে বিশেষ মানবতা বিরোধী চরিত্র সেটিই এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
সরকারপক্ষের লোকজন বলছে তিনি হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছেন। তাদের এ বক্তব্য সত্যিই মারাত্মক অমানবিক। এ পরিস্থিতি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য শুধুমাত্র তাকে একটা পদক দেয়াটাকে আমি বলব অসম্মান করা হয়েছে। ফলে তিনি পদক প্রত্যাখ্যান করে নিজের এবং স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
তিনি বলেন, ধরুন মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি এই ধরণের একটি পদক দিয়ে তার মূল্যায়ন করা হয় তাহলে ব্যাপারটা কিরকম হবে! আমার কাছে তো মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে পদক দেয়ার ব্যাপারটি সেরকম মনে হয়েছে।
গুম-খুন, অত্যাচার-নির্যাতন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, একটি ফ্যাসিস্ট সরকার এভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না।
খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা খুব সহজ হবে এমনটি মনে করেন না ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, তাকে একটা দুর্নীতির মামলায় সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে এবং দেশের মানুষ চুপ করে থাকবে সেটাও আমার মনে হয় না। আমি বিশ্বাস করি বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি যে আস্থা দেশের জনগণের রয়েছে তাতে রাজনীতিতে নতুন গতি তৈরি হবে।
ফরহাদ মজহারের পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: স্বাধীনতা পদক-২০১৫ গ্রহণ করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তিনি বলেছেন, সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি। আমি সম্মানের সাথে ঘোষিত ‘স্বাধীনতা পদক-২০১৫’ গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করছি। প্রশ্ন হচ্ছে- এটা কি তার নিতন্তাই বিনয় নাকি এর আড়ালে কোনো মান-অভিমান অথবা প্রতিবাদ/ক্ষোভ লুকিয়ে আছে?
ফরহাদ মজহার: স্বাধীনতা পদক-২০১৫ গ্রহণ করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, এ খবরটি যখন আমি দেখি তখন তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে গেছে। কারণ তারা একসময় রাজনীতি করেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের অবদান অসামান্য। তবে তার এই অবদানের জন্য সত্যিকারার্থে আমরা তেমন কোনো স্বীকৃতি দেই নি।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার ভুল-ক্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান তো অনস্বীকার্য। তিনি রাজনীতিতে সব সময় নতুন কিছু ভাবতে চেষ্টা করেছেন। আর রাজনীতিতে নতুন করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার বিষয়টি আমার কাছে খুবই শক্ষণীয় বলে মনে হয়েছে। যেহেতু তার দল ন্যাপ এখন সেই পরিমাণ প্রভাবশালী নয়। ফলে আজকের তরুণ সমাজ তার সম্পর্কে খুব কমই জানে। তবে তার অবদানের জন্য শুধুমাত্র তাকে একটা পদক দেয়াটাকে আমি বলব অসম্মান করা হয়েছে।
ধরুন মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি এই ধরণের একটি পদক দিয়ে তার মূল্যায়ন করা হয় তাহলে ব্যাপারটা কিরকম হবে! আমার কাছে তো মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে পদক দেয়ার ব্যাপারটি সেরকম মনে হয়েছে। অথবা ভাসানীকে যদি এরকম একটি পদক দেয়া হয় তো সেরকমই মনে হওয়ার কথা।
ফলে আমি মনে করি যে মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ পদক প্রত্যাখ্যান করে তিনি তার নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছেন, এবং আমরা যারা তাকে সম্মান করি আমাদেরও মর্যাদা রক্ষা করেছেন, স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
রেডিও তেহরান: বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদকে যৌথবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। তার সন্ধান চেয়ে আদালতে রিটও হয়েছে। মাহমুদুর রহমান মান্নাকেও একইভাবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল র্যাব। পরে আদালতে হাজির করা হয়। কিভাবে ঘটনাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছেন?
ফরহাদ মজহার: দেখুন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ আমার খুবই স্নেহভাজন। তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা। বিএনপির অধিকাংশ নেতারা বর্তমানে কারাগারে। তাদের ওপর চলছে দমন পীড়ন নির্যাতন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা তো জানি বাংলাদেশে গুম-খুন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি কি রকমভাবে বেড়ে গেছে।
তবে এ বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ানক একটি ঘটনা। কারণ বিএনপির মতো একটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলের জাতীয় পর্যায়ের একজন নেতা যিনি দলটির মুখপাত্র হিসেবে তাদের বর্তমান সময়ের বক্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছিলেন। দলের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তাকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা হবে এবং দেশের জনগণ জানবে না এটা অত্যন্ত উৎকন্ঠার বিষয়। সালাহউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং মানবাধিকারের লংঘন। বর্তমান সরকারের যে বিশেষ মানবতা বিরোধী চরিত্র সেটিই এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সালাহউদ্দিন আহমেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক বেশি চিন্তিত। আমি মনে দেশের ভেতরের এবং বাইরের সকল মানবাধিকার সংগঠনের এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত। বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করেন তাদের উচিত তীব্র প্রতিবাদ জানানো এবং দাবি করা উচিত যেন অবিলম্বে সালাহউদ্দিন আহমেদকে আমরা দেখতে পাই।
যদি তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকে বা অভিযোগ থাকে তাহলে তাকে আইনের কাছে সোপর্দ করেন। তার স্ত্রী স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, যদি তার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা থেকে থাকে তাহলে তার বিচার করেন। কিন্তু তিনি কি এমন অপরাধ করেছেন যে রাষ্ট্রের পক্ষে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যাবে এবং তাকে আর পাওয়া যাবে না।
এখানে আরো একটা ভীতিকর বিষয় আমরা লক্ষ্য করছি। মিডিয়াতে এবং টেলিভিশনে দেখতে পাচ্ছি যে সরকারপক্ষের লোকজন বলছে তিনি হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছেন। তাদের এ বক্তব্য সত্যিই মারাত্মক অমানবিক। এ পরিস্থিতি আমাদেরকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করছে।
আমি এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও জাতিসংঘের যে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিকমহলের প্রতি আহবান জানাবো এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে। কারণ এ ধরণের কাজ করার অধিকার কোনো রাষ্ট্র বা সরকারের থাকতে পারে না।
রেডিও তেহরান: রমজান মাস শুরুর আগেই ঢাকা মহানগরের দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে চায় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অনেকেই বলছেন, এতদিন চলে গেলেও নির্বাচন করা হয় নি; যখন বিএনপি ও ২০ দল আন্দোলনে তখন সরকার এ নির্বাচন করতে যাচ্ছে এবং আন্দোলনেক ভিন্নখাতে নেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সরকার এ নির্বাচনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কি বলবেন আপনি?
ফরহাদ মজহার: বিএনপিকে রাজনৈতিক দল থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া বা ধ্বংস করে দেয়ার কৌশল ছিল সরকারের। দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দলটিকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা সরকার করেছে যাতে তাদের পক্ষে এই ধরণের একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না হয়। আর সেই জায়গাটিতে তারা গিয়ে পৌঁছেছে। সরকারি দল মনে করছে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সামাজিক আধিপত্যও প্রতিষ্ঠা করবে। এমনিতেই তো রাজনৈতিক আধিপত্য রয়েছে তার ওপর যদি সামাজিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে তো আর কোনো কথা নেই। ফলে আমি বলবো আওয়ামী লীগ তাদের কৌশল অনুযায়ী সামনে এগোচ্ছে।
তবে এরকম দমন-পীড়ন-নির্যাতন, গুম-খুন এসব করে তারা দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকার যেভাবে বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করছে, খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা এসবের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি বাংলাদেশের জনগণ এসব বিষয় খুব ভালোভাবে দেখছে এবং নিরীক্ষণ করছে পুরো পরিস্থিতি। সময় মতো তারা জবাব দেবে। নির্বাচন যদি হয়ও তাহলে জনগণ কিভাবে রেসপন্স করবে তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে।
আমি একটি খবরে দেখলাম মাহমুদুর রহমান মান্না তিনি জেলে থেকেও ঢাকা সিটির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। যদি সেটি হয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো অবশ্যই এটি তার সঠিক সিদ্ধান্ত। আর সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে খুব সহজ হবে না নির্বাচনকে ম্যানিপুলেট না করে নিজেদের দলীয় লোককে তারা জিতিয়ে আনতে পারবে। তবে সরকার যা কিছুই করুক না কেন মনে হয় না যে তারা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে। আর সুষ্ঠুভাবে করলেও তারা তাদের দলের লোককে জিতিয়ে আনতে পারবে বলে মনে হয় না।
রেডিও তেহরান: দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে কিন্তু গ্রেফতার করা হয় নি। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আপনার কি মনে হয়- রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি নেত্রীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না?
ফরহাদ মজহার: হ্যাঁ আপনি প্রশ্নের মধ্যে ঠিকই বলেছেন। আমরা এমনটি অনুমান করতে পারি। এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের অধীনস্ত থেকে বিভিন্ন সময়ে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে যেভাবে কাজ করতে দেখেছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবাই বুঝতে পারি যে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আইন যদি নিজস্ব নিয়মে চলে সেক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট জারি করার পর অবশ্যই তাকে গ্রেফতার করতে হবে। এছাড়া আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিকমহল বা কূটনৈতিক মহল বলছে বাংলাদেশে এ ধরণের একটা পরিস্থিতি তৈরি হলে যে সহিংসতা হবে তা রাজনীতিতে মারাত্মক অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। তাদের ভাষায় একটা এক্সট্রিমিজন ডেভালপ করবে। আর ১৬ কোটি মানুষের দেশে এক্সট্রিমিজম ডেভালাপ করাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে তারা মনে করে। ফলে তারা এখানে এধরণের একটি পলিটিক্স ডেভালাপ করতে দিতে চায় না। আর চায় না বলেই তাদের একটা চাপ এখানে অব্যাহত রয়েছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার ঠিক কাজ করছে না, তারা বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে ম্যানিপুলেট করছে এ কথাটা আন্তর্জাতিক সমাজ কূটনৈতিক কারণে স্পষ্ট করে বলছে না। তারা এভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে যে খালেদা জিয়াকে যদি গ্রেফতার করা হয় তাহলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হবে।
তবে এক্সট্রিমিজম বলতে তাদের ভাষায় বাংলাদেশে বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেটা তারা রাখতে পারবে না। আর সেই চাপের কারণেও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আমার মনে হয় না খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা খুব সহজ হবে। তাকে একটা দুর্নীতির মামলায় সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে এবং দেশের মানুষ চুপ করে থাকবে সেটাও আমার মনে হয় না।
রেডিও তেহরান: আচ্ছা, দেশের চলমান রাজনীতির কথা যখন চলেই এল তাহলে এ প্রসঙ্গে একটু কথা বলি। চলমান আন্দোলন কোন পর্যায়ে এবং কোথায় গিয়ে এর শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে?
ফরহাদ মজহার: দেখুন চলমান রাজনীতির কথা যখন আপনি বলছেন তখন আমার কাছে যে বিষয়টি মনে হচ্ছে সেটি হচ্ছে বর্তমানে যে সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে তারা একটা ফ্যাসিস্ট সরকার। আর তাদের দ্বারা সমাজে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একটি ফ্যাসিবাদ কায়েম রয়েছে। এখানে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ কায়েম রয়েছে। আর একে মোকাবেলা করতে গিয়ে বিরোধী বিএনপির যে ধরণের রাজনীতি করার দরকার ছিল তা তারা করতে পারে নি। দীর্ঘদিন ধরে আমার লেখায় এ বিষয়টি আমি উল্লেখ করেছি। যেকারণে আমি বলব বর্তমান আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে যথার্থ রাজনীতি করতে এখানে দেয়া হয় নি।
অনেকে বলে থাকেন বিরোধী বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বলে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তবে তারা যে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বলা হচ্ছে এরপক্ষে কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। আমরা দেখেছি বিএনপির চেয়ে অনেক দুর্বল সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ৭০’র দশকে আন্দোলন করেছে। তারা মূলত তখন ৬ দফা নিয়ে আন্দোলন করেছে এবং তারা কি চেয়েছি জনগণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল।
কিন্তু বর্তমান বিরোধী পক্ষ বিএনপি জোটের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করলে আপনারা দেখতে পাবেন যে তাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি বা সত্যিকারার্থে কি চান তা স্পষ্ট নয়।
তবে তাদের দুটো বিষয় আমার সামনে এসেছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নেয়ার আগ পর্যন্ত তার যেসব বক্তব্য ও বিবৃতি প্রতিদিন মিডিয়ায় আসছিল সেখানে বলা হয়েছে- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে আন্দোলন করছে সেখানে তারা মনে করেন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর যে অবস্থায় বাংলাদেশ চলছে সেভাবে দেশ চলতে পারে না। প্রয়োজনে সংবিধানের পুর্নলিখন তারা দাবি করছেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার যে ঘোষণা সেখানে কথাগুলো ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার এই তিন নীতির ভিত্তিতে সংবিধানের সংস্কার এবং নতুনভাবে বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চান। এই কথাটা বিএনপির মুখপাত্রের বিবৃতিতে এসেছে। তবে একথাটা আমরা বেগম খালেদা জিয়ার মুখ থেকে শুনতে চাই। খালেদা জিয়া যদি নিজের মুখ থেকে একথা জনগণকে জানাতেন এবং বলতেন এজন্যই আমরা লড়াই করছি। তাহলে এর একটা অন্যরকম শক্তি দেশে তৈরি হতো। আমরা তখন দেখতাম দেশে নতুন একটি রাজনীতি শুরু হয়েছে।
এছাড়া ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একটা প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলুন বিভিন্ন ওয়ার্ডে, পাড়ায় মহল্লায়। তারমানে হচ্ছে ২০ দলীয় জোটের সবাইকে নিয়ে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা। কিন্তু সেটাও সত্যিকারার্থে বাস্তবায়ন করতে পারে নি তারা বা সেই কমিটির মূল লক্ষ্য কি হবে, তারা কি করতে চায় তা এখানে স্পষ্ট নয়। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত না বিরোধী দল একটি সুস্পষ্ট রাজনীতি জনগণের সামনে হাজির করতে না পারছে এবং সেই রাজনীতির বক্তব্য আসতে হবে খালেদা জিয়ার নিজের মুখ থেকে। আমি বিশ্বাস করি বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি যে আস্থা দেশের জনগণের রয়েছে তাতে রাজনীতিতে নতুন গতি তৈরি হবে।
বিএনপি যে শুধুমাত্র একটা নির্বাচন চায় এমনটি নয়; তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু চায় যা জনগণের প্রত্যাশার মধ্যে পড়ে। তারা একটু নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায় এবং যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সংবিধানের পুর্নলিখন করবে। আর এ রাজনীতিই বাংলাদেশে এখন দরকার। আর খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এ বক্তব্যই শুনতে চায় জনগণ। তার ভিত্তিতে ২০ দলীয় জোটের শরীক ও নির্দলীয় মানুষ যারা দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি চান তারা ঐক্যবদ্ধ হবে এবং তখন বর্তমান পরিস্থিতির অবসান হতে পারে।