৫২ জাতীয় ডেস্ক ।।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আজ শনিবার রাত ১০ টা ০১ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে কামারুজ্জামানের শাস্তি দ্বিতীয় কার্যকর করা হলো। এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথম ফাঁসি কার্যকর করা হয় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার।
পরিবারের সাক্ষাত : আজ শনিবার দুপুরে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরে সরকারের নির্বাহী আদেশ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পৌঁছে। কারাগারে এ আদেশ পৌঁছানোর পর তা তাকে পড়ে শুনানো হয়।
বিকেলে কামারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তার পরিবার। বিকেল ৪ টা ৬ মিনিটে দুইটি সাদা মাইক্রোবাসে করে কারা ফটকে উপস্থিত হন তারা। সাক্ষাত শেষে সোয়া ৫টার দিকে তারা বের হয়ে যান।
শনিবার দুপুরে কামারুজ্জামানের ছেলেকে কারা কর্তৃপক্ষ টেলিফোন করে। তখন বলা হয়, বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে পরিবার সদস্যদের কারাগারে পৌঁছার কথা বলা হয়েছে।
তওবা পড়ানো : কামারুজ্জামানকে তওবা পড়িয়েছেন কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। ফাঁসি কার্যকর করার আগে দণ্ডিত ব্যক্তিকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তওবা পড়াতে হয়। কারা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
রাত ৯ টার পর মাওলানা মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার কনডেম সেলে যান। ঐ সময় একজন ডিআইজি উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনার শেষ রাত। এই রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।
এর আগেই কামারুজ্জামান ওজু ও খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন। এরপর তিনি এশার নামাজ আদায়ের পর নফল নামাজ আদায় করেন।
কারা মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাকে প্রথমে বলেন, আপনার কৃত কর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। কিন্তু আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃত কর্মের জন্য তওবা করেন।
এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট দশেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা : এর আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব। ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রবেশ : ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করেন আইজি প্রিজন, ডিআইজি প্রিজন এবং লালবাগ জোনের ডিসি। আর ৭টা ৫৫ মিনিটে র্যাবের ইন্টিলিজেন্স প্রধান আবুল কালাম আজাদ কারাগারে প্রবেশ করেন। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী, জেলার নেচার আলম ও একজন সিভিল সার্জন কারাগারের ভেতরে রয়েছেন।
বিচার শুরু : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেরারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ৪ জুন বিচার শুরু হয়েছিল।
প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয় একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন। একাত্তরের ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন।
এ বাহিনী বৃহত্তর ময়মনসিংহে (ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল) গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত করে।
প্রথম অভিযোগ : এতে বলা হয়েছে, ৭১’র ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারারাত নির্যাতন করা হয়। পরদিন আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ : কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে মাথা ন্যাড়া করে উলঙ্গ অবস্থায় গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায়।
তৃতীয় অভিযোগ : ৭১’র ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। এ সময় ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের মহিলারা। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত।
চতুর্থ অভিযোগ : ৭১’র ২৩ আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যায় আবুল কাশেম।
পঞ্চম অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দু’জনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ ৮ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ষষ্ঠ অভিযোগ : ৭১’র নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
সপ্তম ও শেষ অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান দিন দুপুরে কামারুজ্জামান আল-বদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন সকালে আলবদররা ওই দু’জনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করান। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফ দেন। আল-বদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
আপিল বিভাগের রায় : গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানের মামলার চূড়ান্ত রায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। ওই দিন রায় ঘোষণায় বলা হয়, আপিলকারী কামারুজ্জামানকে এক নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হলো। অভিযোগ নম্বর ২ ও ৭-এর সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখা হলো। অভিযোগ নম্বর-৩ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে সব বিচারক একমত হয়েছেন, তবে ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে। অভিযোগ নম্বর-৪ প্রমাণিত হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। এটি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলার আপিল বিভাগের তৃতীয় রায়। এর আগে আপিল বিভাগ একই অপরাধে আবদুল কাদের মোল্লা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় রায় দেন। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পরিবর্তন করে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন আপিল বিভাগ। সাঈদী কারাদণ্ড ভোগ করছেন। আর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। এরপর কামারুজ্জামানের দণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ (১, ২, ৩, ৪ ও ৭) প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। এ কারণে পাঁচটিতে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটিতে (অভিযোগ ৩ ও ৪) ফাঁসি, দুটিতে (অভিযোগ ২ ও ৭) যাবজ্জীবন এবং একটিতে (অভিযোগ ১) ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অবশিষ্ট দুটি অভিযোগ (৫ ও ৬) প্রমাণ করতে না পারায় তা থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান আপিল করলে ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রায়ে সই করেন বিচারকরা। ওই দিনই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এ রায়ের কপি পাওয়ার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এ পরোয়ানা পেয়ে সেদিনই কারা কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানকে পরোয়ানার কথা অবহিত করে। এর ঠিক ১৫ দিনের মাথায় ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা।