৫২ জীব-বৈচিত্র ডেস্ক ।।
নেপালে গত শনিবারের ভূমিকম্প কি এ অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস? যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের গবেষকেরা এ অঞ্চলে আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রজার বিলহাম সতর্ক করে বলেছেন, গতকালের এই ভূমিকম্প আরও বড় কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাবস্থাও হতে পারে। এমনকি এই ভূমিকম্পের পরাঘাত আগামী দুই মাস পর্যন্ত যেকোনো সময় আসতে পারে।
আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা
গতকাল ৭ দশমিক ৯ মাত্রার পর আজ দুপরে আবার ৬ দশমিক ৬ তীব্রতার ভূমিকম্প হয়েছে। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও নেপালে। ভারতের বিশেষজ্ঞদের বরাতে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত ৮০ বছরের মধ্যে নেপালে গতকালের ভূমিকম্পই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই এলাকায় এর চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, ১০ কোটি টন টিএনটি বিস্ফোরিত হলে যে শক্তি নির্গত হয় ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে সে মাত্রার কম্পন হয়েছে। হায়দরাবাদভিত্তিক ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক হার্শ কে গুপ্ত বলেন, ‘এই অঞ্চলে বিশাল চ্যুতির কথা আমরা জানি, যা বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটায়। রিখটার স্কেলে ৮ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার সিরিজ ভূমিকম্পের জন্য এই চ্যুতিগুলো দায়ী। তাই বলা যায়, এই অঞ্চলের সম্ভাব্য শক্তিশালীতম ভূমিকম্পের মধ্যে এটি পড়ে না। শক্তি নির্গতের কথা বললে বলা যাবে, ওই অঞ্চলে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত আছে তার ৪ বা ৫ শতাংশের বেশি শক্তি এই ভূমিকম্পে নির্গত হয়নি।’
হিমালয় অঞ্চলে ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করছেন খড়গপুরের আইআইটির অধ্যাপক শঙ্কর কুমার। তিনি বলেছেন, ‘ছোট আকারের নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের সমান শক্তি নির্গত হয়েছে এই ভূমিকম্পে। কিন্তু ভিন্নভাবে বললে, ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে আমরা ভাগ্যবান। কারণ, এখানে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারত। মূল বিষয়টি হচ্ছে, কী পরিমাণ শক্তি নির্গত হচ্ছে সেটি। ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা ৭ দশমিক ৯ মাত্রার চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ গুণ বেশি।’
ভারতের গবেষকেরা বলছেন, গতকালের ভূমিকম্পে ভারতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও এখনো ভূকম্পন-পরবর্তী ঝাঁকুনির ঝুঁকি কমেনি। ভূমিকম্পের পর থেকে বিভিন্ন মাত্রার ১৫টি কম্পন অনুভূত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো সময় এ ধরনের ভূমিকম্পের পরাঘাত আসতে পারে। ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার দুই মাস পরেও এ ধরনের ঝুঁকি থেকে যায়। এ ধরনের পরাঘাত বা কম্পন কখন হবে, তা বলা সম্ভব নয়। এটা প্রতিরোধেরও কোনো উপায় নেই। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পূর্ব সতর্কতা জরুরি।
কেন বারবার ভূমিকম্প হচ্ছে?
কেন বারবার হিমালয়ের পাদদেশের ছোট্ট এই দেশটি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক কারণেই এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি। আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ভারত একটি আলাদা দ্বীপ ছিল, যা দ্রুত সরে এসে এশিয়ার সঙ্গে ধাক্কা খায়। মধ্য এশীয় টেকটোনিক প্লেটের নিচ দিয়ে ভারতীয় প্লেট অতি ধীরে ধীরে ঢুকে যাওয়ার ফলে এখানকার পর্বতগুলো এখনো আকার পাচ্ছে। প্রতি বছর এই দুটি প্লেট দুই ইঞ্চি করে পরস্পরের দিকে সরে আসছে। এতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড চাপ। টেকটোনিক প্লেট হচ্ছে ভূত্বকের বিশাল খণ্ড, যা সঞ্চরণশীল।
যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড রথারি বলেন, হিমালয়ের পর্বতমালা ভারতীয় প্লেটের ওপর দিয়ে প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। সেখানে দুই থেকে তিনটি বড় ধরনের চ্যুতি রয়েছে। আর আছে কিছু খুব মৃদু গতিতে সঞ্চরণশীল চ্যুতি। এগুলোর সঞ্চরণের কারণেই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক দশক ধরেই নেপালের কাঠমান্ডুর মানুষকে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, টেকটোনিক প্লেটের এই সংঘর্ষে গতকাল নেপালের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ, সেখানকার ভূমির গঠনই ভূমিকম্পের এই ঝাঁকিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। নেপালে যেভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়, তা এই ঝাঁকি থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
গতকালের ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল কম। ভূপৃষ্ঠের মাত্র ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার নিচে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি স্থল। এর ফলেই ভূপৃষ্ঠে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হয়েছিল। মূল ভূমিকম্পের পর চার ঘণ্টা পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪টি কম্পন রেকর্ড করেন গবেষকেরা। ৬ দশমিক ৬ মাত্রার একটিসহ কম্পনগুলোর মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫। পরবর্তী কম্পনগুলোর শক্তি ৩০ গুণ কমে গেলেও যেসব ভবন এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো পরবর্তী ছোট কম্পনেও ধসে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
হিমালয় অঞ্চলের অধিবাসীদের বেশির ভাগই যে ধরনের অবকাঠামোতে বাস করে, সেগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত এগুলো দুর্বল ইট ও চুনসুরকি দিয়ে তৈরি। আগের অভিজ্ঞতা থেকে আরেকটি বড় ধরনের যে উদ্বেগ রয়েছে তা হলো, এখানে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এ পার্বত্য অঞ্চলে এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেগুলো পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। এসব গ্রাম মাটি ও পাথরের নিচে চাপা পড়ে একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। জিওহ্যাজার্ডসের প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক ব্রায়ান টাকার বলেন, কাঠমান্ডু ও এর আশপাশের অঞ্চল পুরোনো হ্রদের শুকনো ভূত্বক দিয়ে তৈরি, যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে। এখানকার মাটি খুবই নরম যা ভূকম্পনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শুধু কাঠমান্ডু নয়; তেহরান, হাইতি, লামা, পেরু, পাদাং, ইন্দোনেশিয়াও একই রকম ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এসব অঞ্চলে টেকটোনিক খাঁজ রয়েছে। এখানকার ভবন তৈরির মান এবং ভূমিকম্পের প্রস্তুতিও পর্যাপ্ত নয়।
জিওহ্যাজার্ডস ইন্টারন্যাশনাল নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার মতে, প্রতি ৭৫ বছর পর পর নেপালসহ ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হানছে। ৮১ বছর আগে ১৯৩৪ সালে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে নেপালের ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল এভারেস্ট থেকে ছয় মাইল দক্ষিণে। ১৯৮৮ সালে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে এক হাজার মানুষ মারা যান।
জিওহ্যাজার্ডসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ব্রায়ান টাকার বলেন, নব্বইয়ের দশকে তার প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ১৯৩৪ সালের মতো ভূমিকম্প যদি আবার ঘটে তবে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাবে। কারণ নেপালের শহরগুলোতে বড় বড় দালানকোঠা উঠছে যা সহজেই ভেঙে যাবে। চলতি মাসেই জিওহ্যাজার্ডস তাদের তথ্যে জানিয়েছে, নেপালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সাড়ে ছয় শতাংশ এবং কাঠমান্ডু অন্যতম বড় শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। শুধু কাঠমান্ডুতেই ১৫ লাখ মানুষ বাস করছে।
এশিয়া অঞ্চলে ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রজার বিলহাম। তিনি বলেন, গতকালের ভূমিকম্প এক থেকে দুই মিনিট স্থায়ী ছিল। কাঠমান্ডুর নিচ দিয়ে প্রায় ৭৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত চ্যুতির মধ্যে ভূত্বকের এই খাঁজটি প্রায় ১০ ফুট পর্যন্ত সরে গেছে। এতে পুরো কাঠমান্ডু শহরটিই দক্ষিণ দিকে পায় ১০ ফুট সরে যায়।