**আনুপাতিক পদ্ধতি: নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা কী বলছে**
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। কেউ আনুপাতিক ভোটের পক্ষে, আবার কারো মত আছে বিপক্ষে। এ নিয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে নেপাল, সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাও। এ দুই দক্ষিণ এশীয় দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের কী শেখার আছে, তা নিয়ে লেখা আলোচ্য নিবন্ধটি।
**সমস্যাটি কোথায়**
বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায়, একজন প্রার্থী তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে কম ভোট পেয়েও জিতে যেতে পারে, যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিভিন্ন প্রতীকে বিভক্ত থাকে। এ কারণে পার্লামেন্টে নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ নন। অধিকাংশ ভোটার প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে পড়েন।
**নেপালের সংস্কার**
নেপালে এই সমস্যাটি ছিল না জাতিগত বা ধর্মীয়। দেশটির পুরোনো ভোট ব্যবস্থায়, গরিব ও ছোট ছোট জাতিগুলোর প্রতিনিধিত্ব হতো না। এসব মানুষের চাহিদা পূরণ করতেই নেপালে আনুপাতিক ব্যবস্থা চালু করা হয়।
নেপালের নির্বাচনী ব্যবস্থা তিন স্তরে বিভক্ত: জাতীয় পার্লামেন্ট, প্রাদেশিক সরকার এবং স্থানীয় সরকার। জাতীয় পার্লামেন্টে ৬০ শতাংশ আসন সাধারণ ভোটে এবং বাকি ৪০ শতাংশ আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। সাতটি প্রদেশেও একই নিয়ম। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সাধারণ পদ্ধতিতে হয়।
নেপালের সংস্কারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, সব স্তরে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। স্থানীয় স্তরে এই সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে প্রতি ওয়ার্ডের অন্তত একজন নারী সদস্য দলিত হতে হবে।
**শ্রীলঙ্কার সংস্কার**
শ্রীলঙ্কায়ও জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে ভোটে প্রতিনিধিত্বের অভাব ছিল। এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ তামিল সম্প্রদায়ও রয়েছে। পুরোনো ভোট ব্যবস্থায় তামিলরা প্রতিনিধিত্ব পেত না। পরে আনুপাতিক পদ্ধতি চালু করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়।
শ্রীলঙ্কাতে পার্লামেন্টে ২২৫টি আসন। এর মধ্যে ১৯৬টি আসনে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হয়। বাকি ২৯টি আসন ‘জাতীয় আসন’ হিসেবে সংরক্ষিত। দলগুলো আগে থেকেই জাতীয় আসনের জন্য প্রার্থীদের একটি তালিকা জমা দিতে হয়, যা পরে সংশোধন করা যায়।
একটি চমকপ্রদ ব্যাপার হল, নির্বাচনী এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দল বা প্রতীককে সেই এলাকা থেকে ‘বোনাস’ হিসেবে একটি আসন দেয়া হয়। এই বোনাস ব্যবস্থা বড় দলগুলোকে আনুপাতিক সংস্কারে সম্মত করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
**অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয়**
শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার একমাত্র সমস্যা নয় পার্লামেন্টের আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে কম ভোট পেয়েই ‘বিজয়ী’ হয়ে যাওয়া। বরং সব পেশার মানুষ, নারী ও প্রান্তিক সমাজের গরিব মানুষদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ভোট ব্যবস্থা সংস্কারের প্রধান দায়িত্ব।
বাংলাদেশের ‘বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান’ এসব নিরীক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভোটব্যবস্থাকে আরও অগ্রসর স্তরে নিয়ে যেতে পারে। সংস্কারের মাধ্যমে সেসব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সংসদে আনা সম্ভব, যারা কখনও তেমন সুযোগ পায়নি। নারী আসনের পাশাপাশি সংখ্যালঘু জাতি ও সংখ্যালঘু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পথও খুঁজে বের করা দরকার।
যদিও এমন সংস্কারে প্রধান দলগুলোর সম্মতি প্রয়োজন। বিশেষ করে বিএনপিকে আনুপাতিক পদ্ধতিতে সম্মত করানোর জন্য শ্রীলঙ্কার ‘বোনাস আসন’ ধারণাটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ একটি দুর্দান্ত মুহূর্তের মধ্যে রয়েছে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও সমাজ গঠনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সংস্কার কার্যক্রমকে বৈপ্লবিক হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই করতে হবে।
**লেখক:** আলতাফ পারভেজ, গবেষক ও লেখক