মাকে ছেড়ে এই প্রথম দূরে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষা লাভ। কি হল মা সবকিছু গুছিয়ে দাও না তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে যাচ্ছে- আকাশে দেখি মেঘ করেছে, বৃষ্টি হবে হয়তো। আমার মৃদু রাগেও মায়ের কিছুই যায় আসে না, যেন শুনতেও পায় না। কি যেন ভাবছে আর বার বার বলছে, তুই কিন্তু ঠিকঠাক মতো খাবি। রুমে কোনো বড় আপু থাকলে একটু খাইয়ে দিতে বলিস। কাপড় গুলো পরিষ্কার করার দরকার নেই। সব জমিয়ে রাখিস, বাড়িতে এলে পরিষ্কার করে দেবো। মনে করে মশারিটা মেলে নিবি। ক্ষুধা পেলে বিস্কুট আর মুড়কি আছে খেয়ে নিস…
ধুর আমি কি ছোট, এতো চিন্তা করো না তো। দেখো, আমি সব পারবো ঠিকমতো। দরকার হলে ডিম ভেজে ভাত খেতে পারবো। কাপড়ও পরিষ্কার করে নিতে পারবো। তুমি চিন্তা করো না মা। আব্বা ওই দিক থেকে বার বার তাগিদ দিচ্ছে, তাড়াতাড়ি বের হ, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু গোছানো হলো? নাকে মুখে দুটো গুজে কাপড়ের ব্যাগ আর বড় দুটো লাগেজ নিয়ে বাবার সঙ্গে রওনা দিলাম। মাও আমার সঙ্গে বের হলো এগিয়ে দিতে। থাক না মা আর আসতে হবে না, ঠিক যেতে পারবো; আব্বাতো আছেই। মায়ের মুখটা নুয়ে আছে মাটির দিকে। বার বার লুকানোর চেষ্টা চোখের বাঁধ ভাঙা জলের। আমিও বার বার গলাটা পরিষ্কার করে নিচ্ছি ঠাসঠাসে কণ্ঠে কথা বলতে। যেন কিছুই ছুঁয়ে যাচ্ছে না আমাকে।
বাড়ি থেকে যতদূর যাওয়া যায় মা ততদূরই আমাকে জড়িয়ে ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। এর আগেও অনেকবার মাকে জড়িয়ে ধরেছি, আজকের মতো এতো নরম মনে হয়নি কখনো। মায়ের মনের সব কোমলতা আজ বুঝি ভর করেছে তার শরীরেও। মায়ের সামনে থেকে যতদ্রুত যাওয়া যায় ততই ভালো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মনের মধ্যে এতো বেশি তোলপাড় হচ্ছে, একটু অপেক্ষা করলেই হয়তো ওপরের শক্ত খোলসটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে পড়বে।
একপ্রকার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মাকে ছেড়ে দ্রুত পার হোলাম নদীটা। মা দাঁড়িয়ে রইলো নদীর ধারে। মনকে বলছি, জোর করে হলেও পেছন দিকে আর তাকানো যাবে না। কিন্তু ভুল করে কানকে বলা হয়নি তুমি আর শুনো না। হঠাৎই একটি শব্দ যেন আমার কানে এসে তীব্র আঘাত হানলো। মুহূর্তেই দাড়িয়ে গেলাম। দেখলাম আকাশটা ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গেছে, চারপাশ অন্ধকার। পেছনে তাকাতে অন্ধকারের মাঝে মাকে যেন হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু মায়ের কান্নার শব্দটা বজ্রপাতের শব্দ থেকে আলাদা করতে একটুও ভুল হলো না। ইচ্ছা হলো হাতে থাকা সব ফেলে একছুটে মায়ের কাছে যায়। কিন্তু ততক্ষণে আমাকে পার করে নৌকাটা চলে গেছে অন্য যাত্রী নিয়ে। মায়ের কান্না যেন আমাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। বুক ফেটে আমারও কান্না আসছে। আব্বাকে বলতে ইচ্ছে করছে আমি যাবো না। আমার পা দুটো পাথরের চেয়েও যেন ভারি হয়ে গেছে, একপা এগিয়ে যাওয়ার শক্তি অবশিষ্ট নেই।
এখন কি করা উচিৎ আমি বুঝতে পারছি না। কান থেকে কিছুতেই মেলাতে পারছি না মায়ের কান্নার আওয়াজ। বার বার গলা চেপে আসছে, কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। আব্বা বলে উঠলো- তাড়াতাড়ি চল, বৃষ্টিতে ভিজে যাবি কিন্তু। বুঝতে পারছি আব্বারও খুব খারাপ লাগছে।
আব্বার কথায় আবার পা বাড়ালাম। তারপর আর একবারও পেছন দিকে তাকাতে পারিনি। মনের ভেতর কি যেন একটা অপরাধ বোধের পাহাড় জমতে শুরু করলো। শুধুই মনে হতে লাগলো, আমি অপরাধী অনেক বড় একটা অপরাধী। আমি তোমাকে কাঁদিয়েছি।
মাঝে কেটে গেছে অনেকটা বছর। স্বার্থপর আমি এখনো তোমাকে একা করে রেখেছি। নিজের প্রয়োজনে তোমাকে ছেড়ে আজ অনেক দূরে আছি। কিন্তু সেই করুণ সুর আমি এখনো চুল পরিমান ভুলতে পারিনি। আজও ভুলিনি তোমার সেই কষ্টের কথা। বরং সেদিন জন্ম নেয়া অপরাধের পাহাড়কে সর্বোচ্চ উচ্চতা দিতে গড়ে চলেছি।
আমি বুঝি তোমার কষ্ট, ছোট থেকেই তোমাকে অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। একা হাতে সামলে নিয়েছো সংসারের সব কাজ। কষ্টের ক্ষত সারাতে প্রশংসা পেয়েছ খুবই সামান্য। প্রতিদিনই মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিয়েছো, পরনের কাপড় সব সময় পরিষ্কার করে দিয়েছো, পরিচ্ছন্ন বিছানায় শোয়ার অভ্যাসটা তুমিই গড়ে তুলেছো। নিজের দায়িত্ব যখন একটু একটু করে বুঝে নিতে শুরু করেছি তখনি জানলাম তোমার সেদিনের সব উৎকণ্ঠার কারণ। স্বার্থপর দুনিয়ার আমিও যে একটা কুশীলব। আজ তোমার সবচেয়ে কাছে থাকার কথা একমাত্র নাড়ী ছেড়া ধন, তাকেও সরিয়ে রেখেছি অনেক দূরে। আর সেই পাপকর্মটি আমিই সমাধান করেছি। জানি, খাওয়ার সময় হলে আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা বেড়ে যায়। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আমার মুখটা তোমায় জাগিয়ে রাখে। তুমি ভাবো আমি এখনো সেই ছোট্টটি আছি। নিজের কোনো কাজই গুছিয়ে করতে পারিনা।
দূরে থেকে তোমাকে শুধু মনে করা ছাড়া আমার যে কিছুই করার নেই মা। মাঝে মাঝে একটু খবর নেয়া আর অনেক দিন পর কয়েকটি মুহূর্তের জন্য তোমার কাছে ছুটে যাওয়া। আমার এই ছুটে যাওয়াও হয়তো তোমার না পাওয়ার ক্ষতকে প্রলেপ দিতে যৎসামান্য। নির্লজ্জ এই আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা। মাগো আমি সত্যি অনেক পাপী, আমাকে পারলে ক্ষমা করো…