কর্ণফুলীর তলদেশে টানেলের ‘সাত তারকা’ অতিথিশালা ফাঁকা পড়ে আছে, লোকসানে দিন কাটছে
বিলাসবহুল একটি অতিথিশালা তৈরির ফলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল প্রকল্পের ব্যয় অনেকটাই বেড়েছে। এই অতিথিশালা এখন খালি পড়ে আছে আর প্রতিদিন টানেলকে ব্যাপক লোকসানের মুখে দিচ্ছে।
অতিথিশালাটিতে প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের আধুনিক সুসজ্জিত একটি বাংলো রয়েছে। এতে ছয়টি ভবন এবং সামনে একটি সুইমিংপুল রয়েছে। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, এই অতিথিশালাটি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রকল্পের কর্মকর্তারা তাঁর এলে এখানে থাকার কথা ভেবেছিলেন। এটি ছাড়াও ৩০টি রেস্টহাউস বা বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে।
সেতু বিভাগ বলছে, অতিথিশালাটি তৈরি হলেও তা কখনো চালু করা হয়নি। কারণ, সেটা চালু করার মতো জনশক্তি নেই। তবে এতে এ পর্যন্ত সাড়ে চার শ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে।
টানেল নির্মাণ প্রকল্পের যে স্থানে অতিথিশালাটি নির্মাণ করা হয়েছে তাকে ‘সার্ভিস এরিয়া’ বলা হয়। প্রকল্পের শুরুতে ‘সার্ভিস এরিয়া’ ছিল না। মাঝপথে তা যুক্ত করা হয় এবং প্রায় ৭২ একর জায়গাজুড়ে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে পারকি খালের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু দূরে সমুদ্র সৈকত রয়েছে।
সার্ভিস এরিয়াজুড়ে বাংলো এবং রেস্টহাউস ছাড়া রয়েছে টানেলের একটি রেপ্লিকা, সম্মেলন কেন্দ্র, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। এছাড়াও রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি সংরক্ষণের একটি জাদুঘর। এই স্থাপনাগুলোতে ১ হাজার ১৮২ টন ক্ষমতার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (AC) বসানো হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, টানেল প্রকল্পের শেষ সময়ে অতিথিশালাটি যুক্ত করার পেছনে তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও সম্মতি ছিল। ওবায়দুল কাদের এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। তাই তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সার্ভিস এরিয়াতে বাংলো ও রেস্টহাউস ছাড়া রয়েছে টানেলের একটি রেপ্লিকা, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি সংরক্ষণের একটি জাদুঘরও রয়েছে।
সেতু বিভাগ ও পর্যটন কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, পর্যটন কর্পোরেশন আনোয়ারার পারকি সৈকতের পাশের ১৩ একরেরও বেশি জায়গায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স তৈরি করছে। এটি টানেলের অতিথিশালা থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পটি গৃহীত হয়। এটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে ১০টি সিঙ্গেল কটেজ, চারটি ডুপ্লেক্স কটেজ এবং একটি তিনতলা মাল্টিপারপাস ভবন তৈরি করা হচ্ছে। পর্যটন কমপ্লেক্সে একটি হ্রদ এবং শিশুদের খেলার জায়গাসহ বিভিন্ন স্থাপনা থাকবে।
কর্ণফুলী টানেল: দিনে খরচ ৩৭ লাখ, আয় ১০ লাখ
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানেল প্রকল্পে অতিথিশালা নির্মাণের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন কমপ্লেক্স সেখানে যথেষ্ট ছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেছেন, কর্ণফুলী টানেল আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর তেমন ব্যবহৃত হবে না। এই সময়ে টোল থেকে আয় হওয়া টাকা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ খরচের এক চতুর্থাংশও তোলা যাবে না। এই সময়ে শেষদিকে এসে টানেল প্রকল্পে বিশাল টাকা দিয়ে অতিথিশালা তৈরির কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি আরও বলেন, মূলত প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে টাকা লুটপাটের জন্যই এই সবকিছু করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টানেল প্রকল্পে অতিথিশালা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন ছিল না। পর্যটন কর্পোরেশনের পর্যটন কমপ্লেক্স সেখানে যথেষ্ট ছিল।
পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার বন্দরনগরীকে চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে গড়ে তোলার কথা বলে টানেল প্রকল্প গ্রহণ করে। টানেলটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে। প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়।
সরকারের সাথে সরকারের চুক্তি (জিটুজি) পদ্ধতিতে চীনের অর্থয়নে এবং ওই দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টানেলটি নির্মাণ করে