সকল কিছুতেই কেন ‘লীগের ভূত’ দেখা যায়?
জার্মান দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম তাঁর ‘মার্কসের মানবতাবাদী ধারণা’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দুই ধরনের মূল্য থাকে। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য মূল্য। তাই রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের মূল কাজ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা।
ফ্রম মনে করতেন, রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধনের সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা বর্তমানের আলোচনা থাকলেও ভবিষ্যতের কোনো আলোচনা নেই। এখানে অতীতের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। তবে রাজনীতিতে অতীতের আসল কোনো মূল্যই নেই। কারণ, বেকারত্ব, পণ্যমূল্যের বৃদ্ধি, সামাজিক বৈষম্য, স্বাস্থ্য শিক্ষা, শ্রমিকদের মজুরি-ভাতা, ব্যাংক ডাকাতি, পাচার, ডিমের দাম, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন পর্যন্ত বিষয়গুলো বর্তমানেই সমাধান করতে হয়। আর সমাধান হওয়ার পর তা ভবিষ্যতের জন্য কিছু রেখে যায়।
মানুষের বর্তমান সমস্যাগুলো থেকে মুক্তির একটি কর্মসূচি প্রস্তাব করে সেই কর্মসূচির ভিত্তিতেই ভোটাররা সিদ্ধান্ত নেয় কে ক্ষমতায় আসবে আর কে যাবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল ভিত্তি এইটি।
কিন্তু আমাদের রাজনীতি অতীত ঘিরেই প্রায় পুরোটাই আবর্তিত হয়। মৃত নেতাদের প্রতিকৃতি এবং তাদের স্মৃতি আজও মূল রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি আছে কাগজে-কলমে। সংবিধানের মতোই সেগুলো মূল্যবান বাক্সে সযত্নে তুলে রাখার বিষয়। দলের বুদ্ধিজীবীরা সেই কর্মসূচি যত্নসহকারে তৈরি করেন। কিন্তু দলের কোনো নেতাই সেগুলো ধারণ করেন না, আর দলীয় কর্মী-সমর্থকদের কাছেও সেগুলোর কোনো মূল্য নেই। শেষ পর্যন্ত রাজনীতি নেতাপূজা আর পরিবারবাদী সীমিত কোম্পানির বাইরে খুব বেশি এগোতে পারেনি।
বড় দলগুলোর কথা বাদ দিয়ে দিলে, গণতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বেশি গলা ফাটানো যে বামপন্থী দলগুলো, সেখানেও গণতন্ত্রের অল্প পরিমাণ চর্চাই দেখা যায়। ফলাফল হল সেখানেও নেতার কথাই শেষ কথা।
আওয়ামী লীগে অনুশোচনা নেই, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভরসা
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা কমবেশি এই ধরনের একদলীয় শাসন, এক ব্যক্তির শাসন কিংবা নামে-বেনামে সামরিক শাসনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছি। একাত্তরের পর নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক শুরুর একটি বড় সম্ভাবনা এনে দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগ—যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের শাসনকালকে চিরস্থায়ী হিসেবে দেখেছে। ফলে রাজনীতির নামে বিরোধী দলগুলোকে ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করাটাই চলতে থাকে।
রাজনীতি থেকে বর্তমানের বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের পথ দুটিই হারিয়ে গেছে। এই ঘটনারই ফলাফল এক-এগারো। তারপর এলো জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। চবিষের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ধরনের দিক থেকে একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত।
জনগণের সামনে নতুন একটি মুখ, অপরিচিত চেহারাগুলো দাবিদাওয়া নিয়ে আসে। শাসকরা ছাত্রদের বুকে গুলি চালায়। ফলে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি চাওয়া গণমানুষ সবাই রাস্তায় নামে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোও মাঠে নামে। আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বাদে সবার মধ্যে একটি অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যান, তার অলিগার্কিদের শাসন পতন হয়।
এটা অস্বীকার করা যায় না যে আওয়ামী লীগ একটি বড় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করেছে। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে। শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এক হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যা, ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় তাদের এখনো কোনো অনুশোচনা নেই। তারা মনে করছে সারা দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামেনি। এসব ষড়যন্ত্র। গত ১৫ বছরে ব্যাংক লুটে লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বিদেশে। এই অর্থের একটি অংশই দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। অপপ্রচার-গুজবের কারখানা সক্রিয়।
নতুন বাংলাদেশের জন্য নতুন রাজনীতি দরকার। ঢাকায় এখন প্রতিটি খবরের শিরোনামই হচ্ছে সংস্কার। একটির পর একটি কমিশন গঠন হচ্ছে। তবে এটা মনে রাখা উচিত যে, নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পরেও বিভিন্ন কমিশন গড়ে উঠেছিল। তারা বড় বড় ওজনদার প্রতিবেদনও দিয়েছিল। কিন্তু কেউই সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগী হয়নি।
ফলে, সং