আমেরিকা বলেছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটালেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও জোর করে তুলে নিয়ে গুম বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা। এর পরই রয়েছে অনলাইন ও গণমাধ্যমে মত প্রকাশে নানা প্রতিবন্ধকতা, খুবই নিম্নমানের কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার না থাকা।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুরে মার্কিন স্টেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন করা হয়।
প্রতিবেদনটি শুরু করা হয়েছে এভাবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে। যা মাসব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা সৃষ্টি করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে এবং রাজপথে ধারাবাহিক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল এ নির্বাচনকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে। তারা জানায়, বিরোধীদের বর্জনের কারণে এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও ওই সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ওই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট করার আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির ন্যূনতম যুক্তিও খুঁজে পাননি। ওই সময়ে সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের মতে, কেন্দ্রে বা এর আশপাশে ওই নির্বাচনে ১০০ এরও বেশি নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ওই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পঞ্চমবারের মতো উপজেলা পর্যায়ের স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত নির্বাচনে সন্ত্রাস, সহিংসতা, কারচুপি এবং নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা অবাধে ব্যালট পেপারে সিল মারছে এমন ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বলা হয়, মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পাশাপাশি শ্রম অধিকার এবং শ্রম পরিবেশ নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কয়েকটি দলের সহিংসতা ২০১৪ সালে দেশে ভীষণ ক্ষতির কারণ ঘটায়। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইনি বাধা মোকাবিলা করে এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য চলছে। অল্প বয়সে এবং জোরপূর্বক বিয়ে সমস্যা রয়েছে। অনেক শিশু কাজ করতে বাধ্য হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য বড় সমস্যাগুলো হল- আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি দফতরগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি, নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটকে রাখা, দুর্বল বিচারিক ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাহীনতা এবং দীর্ঘ সময় বিভিন্নজনকে আটকে রাখা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে কর্তৃপক্ষ প্রায়ই নাগরিকদের গোপনীয়তা হরণ করে থাকে। এখানকার সবকিছুই রাজনৈতিক বিবেচনায় সম্পন্ন হয়। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাত মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আরেকটি জটিল সমস্যা। কিছু উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) সব সময়ই আইনগত ও সরকারি নানা বিধিনিষেধের মধ্যে থাকে। নারীরা হরহামেশা বৈষম্যের শিকার হন। অল্প বয়সেই জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয় তাদের। এটি একটি বড় সমস্যা।
আমেরিকার মতে, দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাতও উদ্বেগের। বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা প্রায়ই নানাভাবে হামলার শিকার হন। এমনকি এর সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক, কখনও সরকারদলীয় নেতার নামও উঠে আসে। প্রায়ই যৌন নির্যাতনের শিকার হন নারীরা। সংখ্যালঘু নারীরাও।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। যদিও প্রায় প্রতিদিনই এ নিয়ে নানা দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো সদস্য অপরাধ করলে কিংবা কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে, বলতে গেলে তিনি কোনো শাস্তির মুখোমুখিই হন না। এটি বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ভয়াবহতম সমস্যা।