৫২ জাতীয় ডেস্ক ।।
]
রাত ১২টা ১ মিনিটে ১৬২টি ছিটমহলে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে উত্তোলন করা হল বাংলাদেশের পতাকা। সেইসঙ্গে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে ৬৮ বছরের বঞ্চিত অন্ধকার জীবনের প্রতীকী অবসান ঘটালেন ছিটমহলবাসী। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে গেছে ছিটগুলো। এতে পূর্ণ নাগরিক পর্যাদা পেল ৫০ হাজার মানুষ।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এই সমস্যার অবসানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র পেল পূর্ণতা। বাংলাদেশে এখন থেকে ‘ছিটমহল’ শব্দটি থাকবে কেবল ইতিহাসের পাতায়।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আজ নিজের দেশের পতাকা নিয়ে মিছিল করছি, এর চেয়ে আনন্দের কী আছে? আজ আমরা মুক্ত, আজ আমরা স্বাধীন। আটষট্টি বছরের বন্দিত্ব ঘুচেছে আমাদের- এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
গারাতি ছিটমহলের নাগরিক কমিটির সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল ছিটমহল বিনিময়। এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অনেক কাঠ-খড়ি পোড়াতে হয়েছে। বর্তমানে সমন্বয় কমিটির ভারত শাখার প্রাণপুরুষ দীপ্তিমান সেনগুপ্তের বাবা প্রয়াত বিধায়ক দীপক সেনগুপ্ত ১৯৯৪ সালে এই কমিটি গঠন করেছিলেন। তখন থেকেই ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী আমরা আন্দোলন করে আসছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে শুরু করেছিলেন সেখানে শেষ করলেন তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার উদ্যোগেই আজ আমরা ৬৮ বছর পর মুক্তি পেলাম। আশা করছি তার আমলেই আমাদের ছিটমহল এলাকাগুলো বাংলাদেশের অন্য এলাকার মত উন্নত হবে। নতুন করে নাগরিকত্ব পাওয়া মানুষগুলো নাগরিকত্বের স্বাদ পেয়ে ভুলে যাবে আগের সব গ্লানি। আমরা এই দিনটিকে স্মরণে রাখবো। প্রতি বছর এই দিনটিকে আমরা ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করব।”
আনন্দে উদ্বেলিত কুড়িগ্রামের দাসিয়ার ছড়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম নিউজ চ্যানেল ৫২ কে বলেন, “৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দে ভাসছেন তারা। সেইসঙ্গে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা দূর করতে এখন ছিটের অধিবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দাসিয়ার ছড়াকে ইউনিয়ন ঘোষণা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ, ভূমির সুষম বন্টনসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।”
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে শুক্রবার রাতে বাঁধ ভাঙা আনন্দে মেতেছিল ছিটমহলবাসী। তারা রাতে কেক কেটে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে শুভ সূচনা করে। সন্ধ্যার পর সবাই একযোগে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। চলে রাতে বিভিন্ন খেলাধুলা। প্রতিটি ছিটমহলে মোমবাতি, প্রদীপ ও মশালের আলো জ্বালিয়ে জানান দেয়া হয় আমরা আর অন্ধকারে নেই, বাংলাদেশের সব নাগরিকের কাতারে যোগ হয়েছি আমরাও। রাতে প্রতিটি ছিটমহলের মুসলমান সম্প্রদায়ের বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে ৬৮টি করে প্রদীপ জ্বালিয়ে সব অন্ধকার দূর করে দেয়া হয়। তবে পঞ্চগড় সদর উপজেলার গারাতি ছিটমহলে কয়েকটি পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ ছিটমহলে খেলাধূলার পাশাপাশি সন্ধ্যার পর মাদরাসা মাঠে ‘চুক্তির মুক্তি’ নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। আর রাতে কেক কাটার পাশাপাশি চলে বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পী এনে গান-বাজনা আর আলোর খেলা। রাতে পটকা ফুটিয়ে জানান দেয়া হয় আমরা আজ থেকে বাংলাদেশী নাগরিক।
ভারত ও বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড। আর ভারতের মধ্যে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর আয়তনের বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল মিলে গেছে ভারতের মানচিত্রে।
গত ৬-১৬ জুলাই পর্যন্ত যৌথ জনগণনায় বাংলাদেশের ১১১টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ৩ হাজার ৭১৮ জন বেড়ে হয়েছে ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। আর ভারতের ৫১টি ছিটহলের জনসংখ্যা ৬৩১ জন বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮৫৬ জন। উভয় দেশের মধ্যকার ১৬২টি ছিটমহলের বর্তমান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৩০৫ জন।