৫২ মফস্বল ডেস্ক ।।
ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও অস্বাভাবিক জোয়ারে দক্ষিণাঞ্চলের চার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ঘের ও পুকুরের মাছ। অনেক জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানিতে ডুবে থাকায় পচে যাচ্ছে আমন ধানের খেত। সড়কে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটির টাকার বেশি।
বরগুনা: পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, জেলার প্রায় তিন কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০ কিলোমিটার বাঁধের। এসব দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ায় জেলার অন্তত ৭০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী। পাউবোর পানি পরিমাপক মাহতাব হোসেন জানান, গতকাল রোববার জেলার নদ-নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ২১ মিটার; যা স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩৬ সেন্টিমিটার বেশি।
জোয়ারের পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় হুমকিতে রয়েছে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের গোলবুনিয়া বাঁধ, নলটোনা ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া খেয়াঘাট ও নলটোনা বাঁধ। এ ছাড়া সদরের নলটোনা, পাথরঘাটা উপজেলার জিনতরা, কাঁকচিড়া এলাকার কয়েক কিলোমিটার বাঁধ হুমকির মুখে আছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, এক মাসের টানা বৃষ্টি ও জোয়ারে জেলার ২ দশমিক ৯৮০ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ও ৯ দশমিক ৫৪৫ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তালতলী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ৮০৯টি বড় মাছের ঘের ও ৮০৬টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এর মধ্যে ৫০টি রয়েছে গলদা চিংড়িঘের, যার আয়তন ৭৪৪ একর। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার জেলায় আমন আবাদের জন্য ৮ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বীজতলা করা হয়েছে। অতিবর্ষণে ২২৭ হেক্টরের বীজতলা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে সদর, আমতলী, তালতলী, বেতাগী ও বামনা উপজেলায় অন্তত দুই হাজার পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় পানচাষিরা জানান।
আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পানিনিষ্কাশন না হওয়াতে আমতলীর ছয়টি ও তালতলীর পাঁচটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র জলাবদ্ধতা।
ভোলা: সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজাপুর, উত্তর রাজাপুরসহ নয়টি ইউনিয়ন; দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, চরপদ্মাসহ ১০টি ইউনিয়ন, বোরহানউদ্দিন উপজেলার পক্ষিয়া, উত্তর বাটামারাসহ তিনটি ইউনিয়ন; তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহিরুদ্দিন, মনপুরা উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন, চরফ্যাশন উপজেলার কুকুরিমুকরি, মুজিবনগর, ঢালচর ইউনিয়নসহ ৬০টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী।
পাউবো ভোলা ও চরফ্যাশন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভোলা সদর, দৌলতখানসহ সাত উপজেলার প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটার জমি মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। এতে ৫০০ পরিবারের ঘরবাড়িও বিলীন হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, জেলায় ৮৪ হাজার ১২০ হেক্টর আউশ, ১৪ হাজার ২৩০ হেক্টর আমনের বীজতলা ও ৫০০ হেক্টর সবজির খেত প্লাবিত হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহীন সরকার বলেন, প্রায় ২০ কিলোমিটার মহাসড়ক, আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী আবদুস সালাম বলেন, সাত উপজেলায় ১৩০ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়কের ক্ষতি হয়েছে।
পটুয়াখালী: পাউবো জানায়, জেলায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। এসব বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে কলাপাড়া, গলাচিপা, দশমিনা ও রাঙ্গাবালী উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ৭৭টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কলাপাড়ার উপকূলীয় লালুয়া ইউনিয়ন ও মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর এলাকা। রামনাবাদ নদ ঘেঁষা লালুয়া ইউনিয়নে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের দুই কিলোমিটার ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, দুই দিন ধরে জোয়ারের পানিতে নতুন করে আরও ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা: জেলা ত্রাণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সদর, তালা, কালারোয়া ও আশাশুনি উপজেলার ৩৪৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার পরিবার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী আবদুল মান্নান জানান, সাত উপজেলায় ১ হাজার ১৬৫ হেক্টরের আমন বীজতলা, ১ হাজার ৩০৯ হেক্টর আমন, ৯২৫ হেক্টর আউশ, ২৭৩ হেক্টরের সবজি ও ১০ হেক্টরের পান নষ্ট হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ জানান, জেলায় ৪৬ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির চিংড়ি, সাদা মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। পাউবোর বিভাগ-১ নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হামিদ জানান, শ্যামনগর ও আশাশুনির তিন কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। পাউবো বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মালেক বলেন, এক কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানান আশরাফ হোসেন বলেন, ভবনের ভেতরে পানি থাকায় তালার ৩০টি ও কলারোয়ার একটি বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে।