৫২ রাজনীতি ডেস্ক ।।
বিভিন্ন ঘটনায় বিবৃতি দেওয়া থেকে শুরু করে কর্মসূচি ঘোষণা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাতিল বা স্থগিত করা—এসব নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে বিএনপি।
গত দেড় মাসে এমন পাঁচ-ছয়টি ঘটনা দলটির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দুর্ভাবনায় ফেলেছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহের তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে দলের মধ্যম সারির তিনজন নেতা এই প্রতিবেদকের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেন।
সর্বশেষ বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ২ সেপ্টেম্বর বিকেলে এক বিজ্ঞপ্তিতে ৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জোটের পক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তিটি গণমাধ্যমে পাঠান। গণমাধ্যমে এ কর্মসূচির খবর প্রকাশের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান আসে। কারণ, ৫ সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমী। কয়েক ঘণ্টার মাথায় বিএনপির পক্ষ থেকে কর্মসূচি পিছিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর করার কথা জানানো হয়।
জোটের শরিক তিনটি দলের তিনজন নেতা বলেন, ৫ সেপ্টেম্বর রাতে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে পরদিনের বিক্ষোভের জন্য তাঁদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। কখন, কোথায় মিছিল হবে, তা ফোনে জানানোর কথা ছিল। কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি। শেষ পর্যন্ত কেবল বিএনপি রাজধানীর কয়েক জায়গায় ঝটিকা মিছিল করে।
এতে ‘বিএনপি জোটের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে’ বলে মনে করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো জনস্বার্থমূলক একটি ইস্যুতে সমন্বিতভাবে কর্মসূচি পালন করা উচিত ছিল। এ জন্য প্রয়োজনে প্রশাসনের অনুমতি চাওয়া যেত। অনুমতি না দিলে এর অন্য রকম আবেদন থাকত।’
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, খালেদা জিয়া গত বছরের ডিসেম্বরেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন যে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ালে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর আট মাস পর সরকার বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে। কিন্তু এর প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণার আগে দলের নীতিনির্ধারকেরা দেখলেন না ওই দিন কোনো ধর্মীয় বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস রয়েছে কি না। তিন মাসের আন্দোলনে নিষ্ফল ঘরে ফেরার পাঁচ মাস পর মাঠের প্রথম কর্মসূচিতে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে না পারাটাকে আরেকটা ‘ধাক্কা’ বলে মনে করছেন নেতারা।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট খালেদা জিয়ার নামে সন্ধ্যায় বিবৃতি পাঠিয়ে রাতেই তা প্রত্যাহার করা হয়। একই বিবৃতি পরদিন আবার গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এরপর ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনুষ্ঠান করে বিএনপি। কিন্তু গুম দিবস নিয়ে আগের দিন রাত নয়টা পর্যন্ত খবর ছিল না দলটির। রাত ১০টায় চেয়ারপারসনের বিবৃতি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। তখন দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম সংস্করণ ছাপার প্রস্তুতি চলছিল। বিএনপির মধ্যম সারির একাধিক নেতার মতে, এসব ঘটনা দলের উচ্চপর্যায়ে ‘সমন্বয়হীনতা’ বা ‘অদূরদর্শিতার’ বহিঃপ্রকাশ।
এ বিষয়ে বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন দাবি করেন, এটা সমন্বয়হীনতা নয়। তিনি গুম প্রতিরোধ দিবসে বেশি রাতে বিবৃতি পাঠানোর বিষয়ে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বিএনপির চেয়ারপারসন এই প্রথম বিবৃতি দেন। দলের একজন কর্মীর ফোন থেকে চিন্তাটি মাথায় আসে। তাই বিবৃতি তৈরি করে চূড়ান্ত করতে সময় লেগে গেছে।’
সমন্বয়হীনতার কথা তুলে ধরে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, গাজীপুরে বাস পোড়ানোর মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার পরদিন এ নিয়ে দলের মুখপাত্র প্রতিক্রিয়া জানান। এর দুই দিন পর ২৭ আগস্ট বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা সংবাদ সম্মেলন ডেকে আবার ঘটা করে প্রতিক্রিয়া জানান। কিন্তু ওই রাতেই চেয়ারপারসনের নামে দলের মুখপাত্রের সই করা একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে আসে। বিবৃতিটি ছিল জামিনে মুক্তির পর জয়পুরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি মোজাহার আলী প্রধানকে আবার আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এতে জ্যেষ্ঠ নেতারা বিরক্ত হন। কারণ, চেয়ারপারসনের বিবৃতির কারণে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য গণমাধ্যমে সেভাবে গুরুত্ব পাবে না। এ কথা চেয়ারপারসনকে জানালে পরে তিনি ওই বিবৃতি প্রত্যাহার করান।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ওই দিন আমরা তারেক রহমানের অভিযোগপত্রের মধ্যেই থাকতে চেয়েছি। এ কারণে সংবাদ সম্মেলনে অন্য কোনো প্রশ্ন নিইনি। সেখানে চেয়ারপারসন যদি বিবৃতি দেন, গণমাধ্যমে সেটিই গুরুত্ব পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই যিনি বিবৃতিটি পাঠাচ্ছেন, তাঁরও তো আক্কেল থাকা দরকার ছিল।’
অবশ্য দলের মুখপাত্র বলেন, ‘চেয়ারপারসনের বিবৃতি সাধারণত আগেভাগে তৈরি করা হয়। ওই দিন আমি অসুস্থ ছিলাম, তাই বিবৃতিটি ড্রাফট করে ই-মেইলে পাঠাই। কথা ছিল বিবৃতিটি পরদিন যাবে। কিন্তু চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ভুল করে আগের দিন পাঠিয়ে দেন।’
গত ১৭ জানুয়ারি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র্যা বের মহাপরিচালকের ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একই দিনে বিএনপির দুই নেতা আলাদা বিবৃতি দেন। একটি বিবৃতি পাঠান আত্মগোপনে থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। অপরটি আসে বিএনপির গুলশান কার্যালয় থেকে; ২০-দলীয় জোটের পক্ষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান এ বিবৃতি দেন। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হলে পরে রিজভী তাঁর বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেন।
পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়ার সৌদি আরব যাত্রা নিয়ে জুলাই মাসে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। তখন বিএনপির মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ১১, ১২ ও ১৩ জুলাইয়ের যেকোনো দিন খালেদা জিয়া সৌদি আরব যাবেন। সেই যাত্রা এখনো হয়নি। একইভাবে দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চোখের চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া ৮ আগস্ট লন্ডনে যাচ্ছেন। সেই যাত্রাও এখন পর্যন্ত হয়নি। সৌদি ও লন্ডন-যাত্রা স্থগিত না বাতিল করা হয়েছে, সে বিষয়ে বিএনপি কোনো বক্তব্য বা ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত দেয়নি। এসব ঘটনা দলে অব্যবস্থাপনা ও চরম সমন্বয়হীনতা বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীদের অনেকে। এ নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সহসভাপতি শাহ সরোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিএনপির হলোটা কী?’
সূত্র- প্রথম আলো।