৫২ আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।
সংকট মোকাবিলায় দরকার আন্তর্জাতিক সম্মেলন
এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পার হওয়া মোট শরণার্থী ৩,৬৭,৯০২
সাগর পাড়ি দিয়ে মূলত দুটি দেশে যাচ্ছে শরণার্থী: ইতালি ১,২১,০০০, গ্রিস ২,৪৪,৮৫৫
হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া হয়ে গন্তব্য জার্মানি
শরণার্থী নেওয়ার প্রতিশ্রুতি
* জার্মানি এ বছর ৮ লাখ শরণার্থী নেবে
* যুক্তরাজ্য পাঁচ বছরে নেবে ২০ হাজার
* ইইউর কোটায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় পাবে দেড় লক্ষাধিক শরণার্থী
সূত্র: ইউএনএইচসিআর, এএফপি ও রয়টার্স
ইউরোপ অভিমুখে প্রধানত সিরীয় শরণার্থীদের স্রোত থামছে না। সংকট মোকাবিলায় ইউরোপের দেশগুলো কে কতজনকে আশ্রয় দেবে তার কোটা আজ বুধবার প্রকাশ করবে। জাতিসংঘ বলছে, সমস্যার সমাধান ইউরোপ এককভাবে করতে পারবে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন প্রয়োজন।
ইউরোপমুখী শরণার্থী–সংকট মোকাবিলায় শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বের সব দেশের অংশগ্রহণ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ দূত পিটার সাদারল্যান্ড। এই সংকট মোকাবিলায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর জন্য শরণার্থী নেওয়ার কোটা আজ বুধবার ঘোষণা করা হবে। ইইউর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মারকেল বলেছেন, শরণার্থী-সংকট সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হবে কোটা নির্ধারণ। ইতিমধ্যে জার্মানি চলতি বছর আট লাখ এবং নিকট ভবিষ্যতে প্রতিবছর পাঁচ লাখ করে শরণার্থী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে ইউরোপমুখী শরণার্থীর ঢল চলছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশের মানুষ। এর প্রেক্ষাপটে উল্লিখিত পদক্ষেপ নিচ্ছেন ইইউ নেতারা। খবর এএফপি, বিবিসি ও রয়টার্সের।
এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী–বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ইউরোপমুখী মানুষের ঢলে কিছু বাংলাদেশিও আছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ দূত পিটার সাদারল্যান্ড গতকাল মঙ্গলবার জেনেভায় অভিবাসন–সংকট নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের সব দেশকে অবশ্যই অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো দরকার। শরণার্থী–সংকটে ইউরোপ যে সাড়া দিচ্ছে, তা বৈশ্বিক সাড়ার অংশ হওয়া উচিত। এ কারণে আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলন ডাকা প্রয়োজন।
উন্নত জীবনের আশা নিয়ে এসব মানুষ প্রথমে ইউরোপের কোনো একটি দেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। এরপর শেংগেনের (ইউরোপের যে ২৬টি দেশের মানুষকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ভ্রমণ করতে হলে কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় না) আওতাভুক্ত একটি দেশে ঢুকতে চায় তারা। সেখান থেকে তাদের মূল লক্ষ্য পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তথা জার্মানিতে ঢোকা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে শেংগেন জোনে ঢোকার দেশ হিসেবে ইউরোপমুখী এই মানুষের অধিকাংশ ব্যবহার করছে হাঙ্গেরিকে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার এক দিনেই মেসিডোনিয়ায় ঢুকেছে সাত হাজার সিরীয় শরণার্থী। আর গ্রিসের বিভিন্ন দ্বীপে এখন অবস্থান করছে প্রায় ৩০ হাজার শরণার্থী। তাদের মধ্যে লেসবস দ্বীপেই আছে ২০ হাজার। গ্রিস ও মেসিডোনিয়া থেকে তাদের অধিকাংশেরই যাত্রা হবে প্রথমে হাঙ্গেরি, পরে অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানি।
গ্রিসের অন্তর্বর্তীকালীন অভিবাসনমন্ত্রী ইয়ানিস মৌজালাস বলেন, লেসবস দ্বীপে ১৮ হাজার শরণার্থী অবস্থান করছে, যা দ্বীপটির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি। চাপ কমাতে শিগগিরই কিছু শরণার্থীকে অন্য দ্বীপে সরিয়ে নেওয়া হবে। গ্রিসের কোস্টগার্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, গত নয় দিনে ওই দ্বীপ থেকে ১৮ হাজারের মতো শরণার্থীকে দেশটির মূল ভূমিতে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু অভিবাসীর ঢল থামছে না।
এই লেসবস দ্বীপেই গতকাল মঙ্গলবার শরণার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। লেসবস দ্বীপের প্রধান বন্দরে রাতভর প্রায় আড়াই হাজার শরণার্থীকে সামাল দিচ্ছিল কোস্টগার্ড ও দাঙ্গা পুলিশ। গতকাল একপর্যায়ে শরণার্থীরা রাজধানী এথেন্সমুখী একটি ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করলে বাধা দেওয়া হয়। এতে ওই সংঘর্ষ বাধে।
এই দ্বীপে আট থেকে নয় দিন ধরে অপেক্ষা করছেন প্রকৌশল শিক্ষার্থী আলাদ্দিন। তিনি জার্মানিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে যেতে চান। গ্রিস কর্তৃপক্ষের আচরণে ক্ষুব্ধ আলাদ্দিন বলেন, ‘এখানে কী যে পরিস্থিতি! মনে করতে চাচ্ছি না। গ্রিস সরকার এই মানুষগুলোর জন্য কোনো কিছুই করছে না।’
হাঙ্গেরিতেও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করেছে পুলিশ। দেশটির সীমান্ত গ্রাম রসজকে শরণার্থীদের জোর করে নিবন্ধনকেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় শরণার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধ্বস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, শরণার্থীদের এই ঢল শুধু একটিমাত্র সময়ের ঘটনা নয়। এটা প্রকৃত ঢলের শুরু মাত্র। আরও অনেক বছর এই সমস্যা চলতে থাকবে।
ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, চলতি বছর এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯০২ জন। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মারা গেছে ২ হাজার ৮৫০ জন। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই এসেছে ১০টি দেশ থেকে। মানুষ যাওয়ার সংখ্যার দিক থেকে এই দেশগুলোর তালিকায় ৯ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে, মোট সংখ্যার ১ শতাংশ বাংলাদেশি।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, চলতি বছর সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী ঢুকেছে সিরিয়া থেকে; যা মোট শরণার্থীর ৫১ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে থাকা আফগানিস্তান থেকে ঢুকেছে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া ইরিত্রিয়া থেকে ৮ শতাংশ, নাইজেরিয়া থেকে ৪ শতাংশ, ইরাক থেকে ৩ শতাংশ শরণার্থী ঢুকেছে ইউরোপে।
শরণার্থীদের ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে হাঙ্গেরি। দেশটি ২০ সেপ্টেম্বর থেকে সীমান্তে কড়াকড়ি জোরদার করার কথা বলছে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পথে থাকা হাজার হাজার শরণার্থীর ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
যদিও জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা চলতি বছর আট লাখ শরণার্থী গ্রহণ করবে। এর বাইরে দেশটি নিকট ভবিষ্যতে প্রতিবছর পাঁচ লাখ করে শরণার্থী নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর সিগমার গ্যাব্রিয়েল। গত সোমবার সন্ধ্যায় সরকারি টেলিভিশনে তিনি এ কথা বলেন। গ্যাব্রিয়েল আরও বলেন, ‘শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য ইইউর শুধু জার্মানি, অস্ট্রিয়া বা সুইডেনের মতো দেশের ওপর নির্ভর করাটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আমি নিশ্চিত, ইউরোপীয় নীতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।’
জার্মানিতে ঢুকতে শরণার্থীর সংখ্যা গতকাল আরও বেড়েছে। জার্মান পুলিশের মুখপাত্র টমাস বাউম্যান বলেছেন, গতকাল স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত মোট প্রায় ২৬ হাজার শরণার্থী ঢুকেছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গত সোমবার জানিয়েছেন, তাঁর দেশ পাঁচ বছরে ২০ হাজার শরণার্থী নেবে। তবে বিরোধী দল লেবার পার্টি সিরীয় শরণার্থীদের জন্য আরও কিছু করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যাঁ ক্লদ জাঙ্কার আজ বুধবার ইইউভুক্ত দেশগুলোর জন্য শরণার্থী নেওয়ার কোটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবেন। কোটা অনুযায়ী জার্মানি ৩১ হাজার, ফ্রান্স ২৪ হাজার ও স্পেন ১৫ হাজার শরণার্থী নেওয়ার কথা বলা হবে বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় বিভিন্ন সূত্র।
শরণার্থীদের স্বাগত জানাবে ব্রাজিল: সিরীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, সরকার তাদের স্বাগত জানাবে। তারা ব্রাজিলের শান্তি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে।