৫২ জাতীয় ডেস্ক ।।
জাতীয় সংসদ প্রসঙ্গে দেওয়া সাম্প্রতিক বক্তব্য সংবিধান পরিপন্থী উল্লেখ করে সরকার ও বিরোধী দলের সাংসদেরা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে (টিআইবি) সংসদে তলব (সমন) করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এই বক্তব্য দিয়ে টিআইবি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছে। তা ছাড়া এই সময়ে এমন বক্তব্যের পেছনে কোনো ইঙ্গিত আছে বলে তাঁরা মনে করেন।
তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংসদের এই আলোচনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, যদি টিআইবি ভুল করে থাকে, তাহলে বক্তব্য প্রত্যাহার করবে। তবে টিআইবি মনে করছে, তারা ভুল করেনি। তারপরও সংসদের যেকোনো পদক্ষেপকে তারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।
‘পার্লামেন্টওয়াচ’ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সম্প্রতি টিআইবি বলেছিল, বর্তমান জাতীয় সংসদ শুধুই নিয়ম রক্ষার এবং এটি কেবল ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র ভুবনে পরিণত হয়েছে। আরেকটি নির্বাচনই পারে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে। বর্তমান সংসদ ‘পুতুলনাচের নাট্যশালায়’ পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, সংসদ বিরোধী দলের সমালোচনা ও ক্ষমতাসীন দলের প্রশংসার স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে।
টিআইবির ওই প্রতিবেদনের তথ্য ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ। এরপর এ বিষয়ে বক্তব্য দেন শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সরকারদলীয় সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মঈন উদ্দীন খান বাদল, স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী প্রমুখ। এ বিষয়ে বক্তব্য চলার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনকক্ষে আসেন। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।
রওশন এরশাদ বলেন, টিআইবির বক্তব্য ও কার্যক্রম খতিয়ে দেখা দরকার। তারা যে বক্তব্য দিয়েছে, তা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে কি না, তা দেখতে হবে। তারা সাংবিধানিকভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নতুন নির্বাচন চেয়েছে। বিরোধী দলকে কথিত বিরোধী দল বলেছে। পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যার সময় তারা চুপ ছিল। এ মুহূর্তে সংসদ ও বিরোধী দল নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা কতটা যুক্তিসংগত ও সৌজন্যমূলক, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
রওশন এরশাদ আরও বলেন, ১৯৯১ সালের পর বিরোধী দলগুলো কী ভূমিকা রেখেছে? ফাইল ছোড়াছুড়ি, গালিগালাজ করেছে। বর্তমান বিরোধী দল সংসদে জনগণের সমস্যা তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, ‘টিআইবিকে আমরা সংসদে আহ্বান জানিয়েছিলাম। তারা এসে আমাদের সঙ্গে কথাও বলেছে। এরপরও কীভাবে তারা কথিত বিরোধী দল বলে। শিক্ষিত লোক হয়ে এটা কীভাবে বলতে পারে?’
স্পিকারের নেতৃত্বাধীন সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটিতে টিআইবিকে সমন বা তলব করার দাবি জানান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, টিআইবির কোথা থেকে টাকা আসে, কীভাবে খরচ হয়, এর কোনো জবাবদিহি নেই। তাদের একটাই কাজ—বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অগ্রগতি বানচাল করা। দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে টিআইবি বিদেশে বাংলাদেশের মর্যাদাহানি করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনতিবিলম্বে প্রিভিলেজ কমিটিতে সমন করে এবং তাদের হাজির করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তাহলে আমরা প্রশ্ন করতে পারব।’
তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, ‘টিআইবির মুখে কি কখনো বাংলাদেশের প্রশংসা শুনেছেন? বেগম খালেদা জিয়া যখন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, তখন তারা তো কোনো কথা বলেনি।’ তিনি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, টিআইবি বিএনপির অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে টিআইবির চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন, যে ধরনের প্রতিবেদন করি এবং সেটি যখন কারও বিরুদ্ধে যায়, তখন তারা এমন প্রতিক্রিয়া দেখান। বিএনপি আমলেও টিআইবিকে বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, মামলা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, টিআইবি আওয়ামী লীগের পকেটে ঢুকে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, টিআইবি বিএনপির পকেটে ঢুকে গেছে।
গতকাল সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী সিপিএর চেয়ারপারসন। সাবের হোসেন চৌধুরী আইপিইউর প্রেসিডেন্ট। ইফতেখারুজ্জামান আইপিইউ বা সিপিএর নাম শোনেননি। এ নাম না শুনে পিএইচডি কীভাবে করলেন?
টিআইবির সমালোচনা করে মতিয়া চৌধুরী আরও বলেন, ‘সংসদকে রঙ্গমঞ্চ বললেন। আসলে সহেনা যাতনা… নিশিদিনও বসে আছি শুধু পথ পানে চেয়ে…। বসে থাকেন, নির্বাচন পাঁচ বছর পর হবে। নানান সুতার টানে আপনারা নাচতে পারেন। আপনাদের এই নাচের উদ্দেশ্য আছে। যখন সামরিক শাসন আসে, তখন তো আপনারা কথা বলেন না। এই সরকারের বিদেশিদের কাছে আনুগত্য নেই। আপনাদের আছে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানকে ‘অশিক্ষিত ডক্টরেট’ আখ্যা দিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, তিনি সংসদ ও সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ। এ জন্য তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে স্বীকৃত হবেন। তিনি প্রশ্ন করেন, টিআইবি কি সংবিধান, সংসদ আর সরকারের ঊর্ধ্বে? সরকার, সংসদ কি একটি এনজিওর কাছে এত অসহায়? এটি একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সংবিধান ও সংসদের বাইরে এক ইঞ্চিও যাওয়ার উপায় নেই।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘ইফতেখারুজ্জামানকে তিন দিন সময় দিতে চাই। অবিলম্বে অবনত মস্তকে ক্ষমা চাইবেন। জীবনে কোনো দিন সংসদ ও সংবিধান নিয়ে কথা বলবেন না। নতুবা আমার কাছে যে ফাইল আছে, তাতে লিখে দেব। সেই এনজিও টিআইবির অস্তিত্ব থাকবে না। তাদের প্রাণ এই পার্লামেন্টের হাতে। টিআইবিকে যদি পার্লামেন্ট সাসপেন্ড করে দেয়, তাহলে আমার কিছু করার থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও কিছু করার থাকবে না। সংসদের এই ক্ষমতা আছে।’
এ বিষয়ে সুলতানা কামাল বলেন, ‘টিআইবি যদি অসত্য কিছু বলে থাকে, তাহলে ওনারা বলুক, আমরা দুঃখ প্রকাশ করব, সংশোধনী দেব বা বক্তব্য প্রত্যাহার করব। কিন্তু জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কথা বলার অধিকার নেই, এটা মানছি না। কারণ, এটা জনগণের সংসদ। জনগণের প্রতিনিধি হয়ে সাংসদেরা সেখানে যাচ্ছেন।’ তাঁর মতে, তাই সংসদ নিয়ে কথা বলতে না পারাটা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ। সংসদ কীভাবে চলছে, সেটির ওপর নজরদারি রাখাটা রাজনৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। এটা না করলে বরং কর্তব্যে অবহেলা করা হবে।
সুরঞ্জিত আরও বলেন, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোর বিষয়ে একটি আইন সংশোধনের ফাইল তাঁর কাছে আছে। এনজিওর কর্তারা আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে এসে বক্তব্য দিয়েছেন।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামানকে উদ্দেশ করে সুরঞ্জিত বলেন, ‘এখানে এসে কথা বলে গিয়ে বাইরে গিয়ে বলেন “পুতুলনাচ” হচ্ছে। তাহলে আপনারা কি এখানে “বাদুড়নাচ নেচে” গেছেন?’ তিনি এনজিও কর্তাদের উদ্দেশে আরও বলেন, এনজিওগুলোকে তাঁরা অধিকার দিতে চান। কিন্তু যদি সার্বভৌম সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে, সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ করা হয়, তাহলে কেন দায়িত্ব নেবেন?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মহান জাতীয় সংসদের মতো স্থানে টিআইবির প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হওয়াটা এর গুরুত্ব বহন করে। আমরা আশা করি, প্রতিবেদনে যেসব তথ্য, বিশ্লেষণ ও সুপারিশ রয়েছে, তা সাংসদেরা বিবেচনা করবেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে সংসদ যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে টিআইবি সর্বতো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।
সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, যখন দেশের অর্জন বেড়েছে, তখন টিআইবি সংসদ নিয়ে কথা বলেছে। তাদের ট্রাস্টি বোর্ডের পুরো তালিকা রয়েছে। সেখানে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের চিন্তা-চেতনা ও অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন আসে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মঈন উদ্দীন খান বাদল টিআইবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত করে বলেন, ‘জাতির যাতে বারোটা না বাজে, সে জন্য কিছু পেইনফুল (বেদনাদায়ক) অপারেশন করতে হবে।’
জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডে আওয়ামীপন্থীরাই বেশি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর জেনারেল সফিউল্লাহ সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছিলেন। খোন্দকার মোশতাক ও জিয়াও সুবিধাভোগী।