৫২ জাতীয় ডেস্ক।।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখে আপিল নিষ্পত্তি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গতকাল বুধবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। দুই মিনিটে এ রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন প্রধান বিচারপতি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও সহযোগিতা এবং নিজামীর নিজ এলাকা পাবনার সাঁথিয়ায় হত্যা, নির্যাতনের দায়ে আš-র্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া তিনটি অভিযোগের সাজা মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনথ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই কুখ্যাত রাজাকার নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রাখলেন সর্বোচ্চ আদালত। চূড়ান্তরায় ঘোষণার পর এবার দু’পক্ষেরই পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পেতে অপেক্ষার পালা। এর আগে আপিল বিভাগ গত বছর ১৭ জুন জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের এবং ২৯ জুলাই বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পর ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছিল। রিভিউ নিষ্পত্তির পর ২১ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ওই দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। নিজামীর রায় নিয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ আদালতে ছয়জনের আপিল নিষ্পত্তি করা হলো।
নিজামীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বাইরে ও রাজধানীর শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চসহ সারাদেশে স্বস্থি ও আনন্দ-উল্লাস করে মিছিল করেছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। রায়কে অভিনন্দন জানিয়ে দ্রুত তা কার্যকর করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। নিজামীর জন্মস্থন পাবনায় রায়ে সন্তুষ প্রকাশ করে আনন্দ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। রায়ে সন্তুষ প্রকাশ করেছেন ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী, সুশীল সমাজ ও সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সন্তুষ প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল। অন্যদিকে, রায়ের প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে জামায়াত। বিএনপি রায়ের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ একাত্তরে বদরপ্রধান ও জামায়াতের সহযোগী সংগঠন তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীকে আটটি অভিযোগে দোষী সাব্য¯- করে রায় দেন। এর মধ্যে চারটিতে (২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ) মৃত্যুদণ্ড দেন। এ ছাড়া ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গতকাল আপিল বিভাগ সংক্ষিপ্ত রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং পাবনার সাঁথিয়ায় হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে (২, ৪ ও ১৬ নম্বর) তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। নিজামীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যে অভিযোগগুলোয় মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছেথ পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা ও ৩০/৪০ জন নারীকে ধর্ষণ, পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা। ৬ নম্বর অভিযোগ, অর্থাৎ পাবনার করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ হলেও আপিলে তিনি খালাস পেয়েছেন।
আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারদলীয় জোট সরকারের আমলের শিল্পমন্ত্রী নিজামী বর্তমানে জামায়াতের আমির। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে তিনি কাশিমপুর কারাগারে আছেন।
রায়ের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রায়ে সমগ্র জাতি অত্যন্তসস্থষ্ট। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতিকে যারা লাঞ্ছনা ও নির্যাতন করেছিল, তাদের আজ শাস্তি হচ্ছে। এ রায় কার্যকর হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। নিজামীর ফাঁসির রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকায় সন্তুষ প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, সমগ্র দেশবাসীর বহুদিনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। আসামিকে চরম দণ্ড দেওয়া হয়েছে। জাতি সস্তিঅনুভব করছে। সর্বোচ্চ আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সঠিকভাবে রায় দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদের পরিবার ও ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।
প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। দেশ আজ সভ্যতার আরেক ধাপে এগিয়ে গেল। বাংলাদেশে যে যুদ্ধাপরাধী আছে এবং একাত্তরে নিজামীর যে নিষ্ঠুর ভূমিকা ছিল, আজ চূড়াান্তরায়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। তদন্তসংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাননান খান বলেন, জাতি এই রায় প্রত্যাশা করেছিল। রিভিউতে এ রায় বহাল থাকবে এবং রায় কার্যকর হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
অন্যদিকে, নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখাকে ‘গুরুদণ্ড’ বলে মনে করছেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। নিজামীর সঙ্গে পরামর্শ করে রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। আসামিপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ যাদের বিচার করা হচ্ছে, তারা প্রধান আসামি নয়, সহযোগী আসামি। প্রধান আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি আইন অনুযায়ী সহযোগী আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া যায় না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যার চূড়ান্ত বিচারে জাতি কলঙ্ক মোচনের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে আরও কয়েকটি আপিল। আগামী ২ ফেব্র“য়ারি জামায়াতের অপর নেতা মীর কাসেম আলীর আপিলের শুনানি শুরু হবে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বেঞ্চের চার সদস্য গতকাল সকাল ৯টা ৫ মিনিটে এজলাসে আসেন। আপিল বিভাগের বুধবারের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় এ মামলাটি রায়ের জন্য এক নম্বরে ছিল। দুই মিনিটেই সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষ করেন প্রধান বিচারপতি। রায়ে সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়, ‘দ্য আপিল ইজ অ্যালাউ ইন পার্ট।’
নিজামীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তার মধ্যে একাত্তরের ১৪ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ডেমরা, রূপসী ও বাউশগাড়ি গ্রামের সাড়ে চারশ’ মানুষকে গুলি করে হত্যা, ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ, ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ, শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং স্বাধীনতার ঊষালগ্নে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় তার ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ সর্বোচ্চ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এখন যা হবে :আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ২১ থেকে সর্বোচ্চ ২৮ দিনের মধ্যে জেল কোড অনুসারে নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হবে। তবে রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হলে এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্তবাস্তবায়ন করবে।
যেভাবে এগিয়েছে মামলা :ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২১ জুলাই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্তশুরু হয়। ২০১২ সালের ২৮ মে আš-র্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬টি অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এর পর ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৬ জন সাক্ষ্য দেন। নিজামীর পক্ষে তার ছেলেসহ চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আš-র্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন।
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী প্রয়াত গোলাম আযমের উত্তরসূরি হিসেবে ২০০০ সালে জামায়াতের নেতৃত্বে আসেন মতিউর রহমান নিজামী। ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্ম হয় তার।
(সূত্র-সমকাল।)