৫২ জাতীয় ডেস্ক।।
জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছাড়া কোনো যুদ্ধ করা যায় না মন্তব্য করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সেই কাজটিই করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার রংপুরে সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়া শেষে দরবারে প্রধানমন্ত্রী সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাদের সবাইকে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছাড়া কখনোই কোনো যুদ্ধ জয় করা যায় না। তাই আপনাদেরকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।’ গতকাল দুপুরে রংপুরের পাগলাপীরে সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের ব্যবস্থাপনায় ‘ব্রিগেড গ্রুপ আক্রমণ’ মহড়া হয়। এরপরই দরবারে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রংপুর সদরের খলেয়া ইউনিয়নের মাঠে আয়োজিত ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের দরবারে সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে সকালে খলেয়ায় রংপুর সেনানিবাসের ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের শীতকালিন মহড়া প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী। মহড়ার নাম দেয়া হয় ‘সূচাগ্র মেদিনী’। শত্রু’র বিরুদ্ধে দূর্দান্ত আক্রমন শানিয়ে গৌরব উজ্জল বিজয় ছিনিয়ে আনতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সক্ষম তা এ সময় দেখিয়ে দিল এই ডিভিশনের ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের সেনারা। প্রধানমন্ত্রী ভয়ঙ্কর যুদ্ধের নান্দনিক এ মহড়াস্থলে এসে পৌঁছালে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মো. শফিউল হক ও রংপুরের এরিয়া কমান্ডার এবং ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল মো. মাসুদ রাজ্জাক। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এই মহড়া দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ ও প্রেস সচিব ইহসানুল করিম রংপুরে শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন।
মহড়ায় ৭২ ব্রিগেডের ৪র্থ হর্স স্পেশাল ব্যাটালিয়ন, ১৫ ও ১১ ম্যাকানাইজ ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ৯ ইঞ্জিনিয়ার্স, আর্মার ও আর্টিলারি সেনারা অংশ নেন। পুরো মহড়াই ছিল একটি পদাতিক ব্রিগেড গ্রুপের মরণপন আক্রমন চালিয়ে দখলদার শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া। স্থল ও আকাশ থেকে চলে এ যুদ্ধ মহড়া। পদাতিক বাহিনীকে আকাশ থেকে সহায়তা করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও আর্মি এভিয়েশনের এএন-৩২, এফ-৭ ও মিগ-২১ যুদ্ধ বিমান এবং হেলিকপ্টার। এ সময় উত্তর খলেয়া ও দক্ষিণ খলেয়ার আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে আর্টিলারি শেলের গগণবিদারি শব্দে। বিমান বাহিনী ও আর্মি এভিয়েশনের যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার দখলদার শত্রুর ওপর আকাশ থেকে গোলা ও গুলি বর্ষন করে। এ ছাড়াও হেলিকপ্টার আকাশ পথে বহন করে নিয়ে আসে যুদ্ধ ক্ষেত্রের বিভীষিকাময় আতঙ্ক ট্যাঙ্ক ছাড়াও সামরিক যান এপিসি (আর্মার পার্সুনেল কেরিয়ার)সহ বিভিন্ন সামরিক রসদ।
মহড়া দেখার পর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের দরবারে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মহড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের প্রশিক্ষণের দক্ষতায় বলতে পারি, আপনারা সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা বাহিনী।’ সামরিক বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ পদক্ষেপের কথাও বলেন শেখ হাসিনা। সেসময় সেনাবাহিনীতে একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, একটি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশনসহ একাধিক আর্টিলারি রেজিমেন্ট, রিভারাইন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, পদাতিক সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন, ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ও ডিভ অর্ডন্যান্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের অখন্ডতা রক্ষায় যে কোনো অশুভ শক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে আমাদের সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আমাদের সেনাবাহিনী তাদের প্রশিক্ষণে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তাতে করে তারা সত্যিকার অর্থেই গড়ে ওঠা বাহিনী। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালি অফিসার ও সেনা সদস্যগণ এবং আপামর জনসাধারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তারই সাক্ষ্য বহনকারী রংপুর সেনানিবাসে রক্ত গৌরব স্মৃতি সৌধটি দেশমাতৃকার আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আজও অম্লান। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি শহীদদের আত্মত্যাগ আপনাদেরকে দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব পালনে আরও উজ্জীবিত করবে।
এবারের প্রশিক্ষণেও বিজিবি, আনসার এবং বিএনসিসি ক্যাডেটদের সম্পৃক্ত করায় সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আধাসামরিক বাহিনী ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাতৃভূমি রক্ষার এ কৌশল আমাদের সেনাবাহিনীর রণকৌশলে এক ভিন্ন ও প্রশংসনীয় মাত্রা যুক্ত করেছে বলে আমি মনে করি।’ নতুন পে-কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে সেনা সদস্যদেরও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১২৩ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। কোনো সরকারই এতো বেতন বৃদ্ধি করেনি।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আধুনিক বিশ্বের উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম ও উদ্যোগ নেয়া হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ সমকালীন বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সামরিক বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফোর্সেস গোল-২০৩০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আধুনিক ও চৌকস সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার জন্য তার সরকার বদ্ধপরিকর বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৭৪ সালেই প্রতিরক্ষা নীতিতে নির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী সমগ্র দেশকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে, সেনাবাহিনীকেও সেই মোতাবেক সক্ষমতার দিক থেকে স্বতন্ত্র ও প্রশাসনিকভাবে সামর্থ্যবান তিনটি কমান্ডে নিয়োজিত হতে হবে।’ পিতার বক্তব্য উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইতিমধ্যে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন এবং রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’ বরিশাল আঞ্চলের বরিশাল-পটুয়াখালীর লেবুখালীতে এবং রাজবাড়ীতে সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে সেনাবাহিনী সবসময় দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমেও ৬৬ ডিভিশন একটি মহান দায়িত্ব পালন করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে দেশের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীকেও ডিজিটালাইজড করা হয়েছে।
(সূত্র-ইত্তেফাক।)