নূরুল আমিন ভোলা প্রতিনিধি।।
ভোলার কৃষি-সম্মৃদ্ধ রাজাপুর ও ইলিশা ইউনিয়নের কৃষকদের মধ্যে ধান কাটা ও সবজি আবাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। ভাঙনে প্রায় ৩ হাজার একর জমি হারিয়ে অনেক কৃষক এখন দিন-মজুরে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভাঙন ও জোয়ারের তীব্রতায় এসব ফসলের জমি নষ্ট হয়ে গেছে।
ভূমি অফিস, ইউনিয়ন পরিষদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব-ইলিশা ও রাজাপুর ইউপির ৬টি মৌজার প্রায় আড়াই হাজার একর জমি মেঘনা নদীতে বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি জোয়ারের তীব্রতায় আরও ৫ শত একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ওই জমিও আবাদযোগ্য নয়,সব মিলিয়ে ৩ হাজার একর জমিতে প্রায় ৬ হাজার মানুষ বসবাস ও আবাদ করত। সব কিছু হারিয়ে এখন তাঁরা নিঃস্ব: হয়ে পড়েছে।
পুর্ব-ইলিশা ইউনিয়নের কালুপুর ও ইলিশা মৌজা এবং রাজাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ-রাজাপুর, রামদাসপুর, ২৭ দাগ ও সুলতানী মৌজা ঘুরে দেখা যায়, চার ভাগের তিনভাগ জমি ভাঙনে বিলীন। এখনও ভাঙছে, বাকী এক ভাগেও কোনো ফসল নেই। জোয়ারে ভেসে যাওয়ার কারনে জমিতে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারীতেও ওই সব জমি সবজি ও শষ্যে ভরা ছিল।সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা বশির আহমেদ, ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকেরা জানান, গত বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে ভাঙন শুরু হয়। সেই ভাঙন এখনও চলমান। অনেক কৃষক কল্পনাই করতে পারেনি ভাঙন তাঁদের নিঃস্ব করবে।
পানি ও ভাঙনে সবজি, তেলবীজ, আখ, আউশ ও আমন নষ্ট হয়ে যায়। কৃষি কার্যালয় থেকে সকল ইউনিয়নের মতো রাজাপুরে ৩৩৫ জন কৃষককে এবং পূর্ব-ইলিশায় ২৬০ কৃষককে ভর্তুকি হিসেবে গম, ভুট্টা, ফেলন ও খেসারী এবং প্রয়োজনীয় সার দেওয়া হয়। তবে ভাঙন কবলিত কৃষকের জন্য বিশেষভাবে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয়নি। সরেজমিনে গিয়ে জানাযায় কৃষকদের বর্তমান পরিস্তিতি সর্ম্পকে, তাঁদের কৃষি জমি হারিয়ে অধিকাংশ কৃষক এখন দিনমজুর।কালুপুর গ্রামের সোবহান বলেন, তিনি তিন একর জমিতে আমনের চাষ করেছিলেন,সব জমিটুকু মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে।
কথা হয় দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের কৃষক লিটনের সঙ্গে। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি জমি লগ্নি নিয়ে আগাম করল্লা, চিচিঙ্গা, শশা, খিরাই, তরমুজ, মরিচ, বেগুন, বরবটি-সিমসহ নানা রকম সবজি আবাদ করতেন। ছয় মাস আবাদ করে তিনি লগ্নিমূল্য শোধ করেও লাখ লাখ টাকা আয় করতেন।
সেই জমি ফসলসহ মেঘনায় ভেঙে গেছে। লিটন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাঙনে আমিও শেষ, আমার মতো অনেক কৃষকও শেষ অইয়্যা গেছে।’ সে তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে মিলে সাতজনের সংসার নিয়ে বেকার অবস্থায় আছেন। নতুন করে আবাদের জমিও পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
দক্ষিণ রাজাপুরের আব্দুল মালেক বলেন, তাঁদের বাড়ি ঘর, পুকুরসহ ৯ একর জমি মেঘনায় বিলীন হয়েছে। ওই জমির এক একর জমি বছরে ৮০ হাজার টাকা লগ্নি দেওয়া হতো আগাম সবজি জন্য কৃষকদের। তাঁরা প্রায় ১২ মাসই সবজি ফলাতো বলে জানান।
দক্ষিণ রাজাপুরের কৃষক আমিন মিঝি বলেন, ‘৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চাষের জমি লগ্নি নিয়েছি, সেই জমি ফসলসহ ভেঙে গেছে। এখন তাঁকে সমিতির কিস্তি চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।কৃষিজমি ও বসতবাড়ি হারিয়ে শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারের সদস্য দিনমজুর ও রিক্সা চালানোর কাজ করছেন। অনেকে আবার বেকার। দুই ইউনিয়নের কমপক্ষে এক হাজার মানুষ তাঁদের পরিবারের সদস্যদের রাস্তার উপর, স্কুলের বারান্দায়, অন্যের বাড়ির উঠানে, ঘর ভাড়া নিয়ে রেখে ঢাকা-চট্টগ্রামে গেছেন কাজের সন্ধানে। অনেকে স্থায়ীভাবে চলে গেছে।
জানতে চাইলে সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, রাজাপুর ও পূর্ব-ইলিশা ইউনিয়ন একটি কৃষি-সম্মৃদ্ধ এলাকা। ওই এলাকায় ১২ মাস সবজির চাষ হতো। প্রায় ৩ হাজার একর তিন ফসলি জমি ভেঙে যাওয়ায় কৃষকদের ধান কাটা ও সবজি চাষের ব্যস্ততা নেই। তাঁরা এখন দিনমজুর; জমি হারিয়ে কৃষকেরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।এব্যাপারে ভোলা জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা বলেন, ভাঙন কবলিত কৃষক পরিবারকে কোনো জমি দেওয়া হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে ত্রান ও টাকা দেওয়া হয়েছে।