৫২ জাতীয় ডেস্ক।।
টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে লাখো মুসল্লির জিকির আজকার ও তাবলীগ মুরব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে গতকাল বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। আজ আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বিশ্ব তাবলীগ জামাতের আমীর ভারতের মাওলানা সা’দ। মোনাজাত সফলভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
উপস্থিত লাখো মুসল্লি বয়ান শুনে ও এবাদত বন্দেগীতে দিন পার করেছেন। আজ রোববার সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ২০১৭ সালের দু’পর্বের বিশ্ব এজতেমা। মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, নৌকাযোগে ও পায়ে হেঁটে দলে দলে ইজতেমাস্থলে আসতে দেখা গেছে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের টঙ্গীমুখী স্রোত দেখা গেছে। এ স্রোত আজ আখেরি মোনাজাতের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
গতকাল শনিবার ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা গেছে লাখ লাখ মুসল্লিদের পদচারণায় শিল্প নগরী টঙ্গী এক ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পাঞ্জাবি টুপি পরা শুধু মানুষ আর মানুষ। এদিকে বিশ্ব ইজতেমায় বিপুলসংখ্যক আগত মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তায় র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য নিরাপত্তার কাজে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ।
বয়ান: গতকাল শনিবার বাদ ফজর বয়ান করেন মাওলানা খোরশেদ (ভারত), বাদ জোহর বয়ান করেন মাওলানা ফারুক (ভারত), আসরে বয়ান করেন ইউসুফ আলী (ভারত), বাদ মাগরিবে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা শওকত আলীসহ বিশ্ব তাবলীগ জামায়াতের মুরব্বিরা। ইজতেমা মাঠের জিম্মাদারের দায়িত্বে থাকা তাবলীগের একাধিক মুরব্বি সূত্র মানবজমিনকে জানায়।
বয়ানে যা বলা হলো: গতকাল বাদ আসর ভারতের মাওলানা ইউসুফ আলী ইমান, আমল, জাহান্নাম, জান্নাত ও দাওয়াতে মেহনতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তিনি বলেন, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মহান আল্লাহ্র কাছে আমল ছাড়া দুনিয়ার জিন্দিগীর কোনো মূল্য নাই। দুনিয়ার কামাই রোজগার দুনিয়াতেই কাজে লাগবে, আখেরাতে কোনো কাজে লাগবে না। যখন মায়ের পেটে ছিলাম তখন বুঝতে পারি নাই পৃথিবী যে এতো বড়। আবার পৃথিবী থেকে বুঝতে পারছি না যে, আখেরাত কত বড়। তিনি আরো বলেন, জান্নাত হলো চিরস্থায়ী শান্তির জায়গা। জান্নাতে একবার কেউ গেলে সেখান থেকে আর বের হবে না। জান্নাতের জমিনের ঘাস হবে জাফরানের মতো। জান্নাতের ইটের জোড়া হবে রুপার, আর প্লাস্টার হবে হিরা-মুক্তা-জহরত দিয়ে। দুনিয়াতে যার যে পরিমাণ গুনাহ্ হবে পরকালে সে পরিমাণ শাস্তি ভোগ করবে। তাবলীগ জামাতের মুরব্বি মাওলানা ইউসুফ আলী অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তার বয়ানে বলেন, মহান আল্লাহ্র প্রতি কারও কোনো বিশ্বাস ছিল না। সে নিজের অর্জিত সম্পদকে আল্লাহ্’র সম্পদ বলে স্বীকার করতো না।
বরং নিজেকে এসব সম্পদের একচ্ছত্র মালিক মনে করতো। তার সেই সম্পদ দুনিয়াতে কোনো কাজে আসে নাই। ইমান, আমল, আখলাক ভালো থাকলে এবং দুনিয়ার সম্পদ আল্লাহ্’র পথে কুরবান করলে আখেরাতে কামিয়াব হওয়া যায়। জান-মাল আল্লাহ্’র পথে খরচ করলে আল্লাহ্ আরো বাড়িয়ে দেন। মাওলানা ইউসুফ আলী দুনিয়ার ভিআইপিদের নিয়ে গর্ব অহঙ্কারের বিষয় তুলে ধরে তার বয়ানে আরো বলেন, দুনিয়ার যত ভিআইপি আছে সবাইকে একসঙ্গে করে ওজন দিলে একজন নবী, রাসুল (সা:)-এর একটি আঙ্গুলের সমানও হবে না। তিনি আরো বলেন, মানুষ যদি মহান আল্লাহ্র হেদায়েত মেনে চলে তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হবে। দুনিয়ার মানুষকে আল্লাহ্র পথে ডাকার জন্য যুগে যুগে নবী রাসুল পাঠানো হয়েছে এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন বিধানও পাঠানো হয়েছে। দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের ইমান মজবুত হয়। ইমান মজবুত হলে আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে। আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হয়। গত শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ইজতেমার বয়ান শুরু হয়।
বিদেশি মুসল্লিদের প্রতিক্রিয়া: মালয়েশিয়ার নাগরিক আহম্মেদ ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বললে তিনি ইজতেমা সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মক্কায় অনুষ্ঠিত পবিত্র হজের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসম্মিলন। এর ফলে বাংলাদেশে সারা বিশ্বের মুসলিম সমপ্রদায় একত্রিত হতে পারছি। এজন্য বাংলাদেশ ইসলাম প্রচারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ চমৎকার একটি দেশ। সুদানের নাগরিক ওমর বিন ইসাক বলেন, তাবলীগ জামাত বিশ্ব মুসলমানের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। এর মাধ্যমে জামাতবন্দি হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করাসহ দ্বীনের মেহনত অর্থাৎ দাওয়াতি কাজ করা যায়। দেশটিও খুব সুন্দর এবং এদেশের মানুষ অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ। বিন ইসাক বলেন বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশে এবার নিয়ে চারবার এসেছি। এখানে প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এদেশের মানুষগুলো ধন্য। তিনি বলেন, ইজতেমা থেকে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। জানা যায় আল্লাহ ও রাসূল (সা:) সম্পর্কে। আখিরাত ও পরকাল সম্পর্কে জানতে তাই এখানে ছুটে এসেছি।
১ বিদেশিসহ ২ মুসল্লির মৃত্যু: ইজতেমায় মালয়েশীয় নাগরিকসহ ২ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন- মালয়েশিয়ার শাহিদান বিন ইব্রাহিম (৪৮), জামালপুর সদরের পাকুল্লার আবুল কাশেম (৬৫)। ইজতেমা ময়দানে তাদের দুজনের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ইজতেমা মাঠের পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কর্তব্যরত পুলিশ জানায়, সকালে শাহিদান বিন ইব্রাহিম অসুস্থ বোধ করলে তাকে প্রথমে টঙ্গী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়ার পথে দুপুর দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তার মরদেহ মালয়েশীয় দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি। টঙ্গী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নিজ খিত্তায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন আবুল কাশেম। সেখান থেকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে আনার আগে পথেই তার মৃত্যু হয়েছে। আবুল কাশেমের লাশ তাদের গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়েছে বলে জানান বিশ্ব ইজতেমার মাসলেহাল জামাতের জিম্মাদার আদম আলী।
বিদেশি মেহমান: এ পর্বে ও শনিবার বিকাল পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০টি দেশের বিদেশি মেহমান এবং প্রথম পর্বের কিছু মেহমানসহ ইজতেমা মাঠে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার বিদেশি মেহমান অবস্থান করছে বলে ইজতেমার আয়োজক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।
চিলাভুক্ত মুসল্লি: এ পর্বেও ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশগ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের তাবলীগি মুরব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলীগি কাজে পাঠানো হবে।