৫২ জাতীয় ডেস্ক।।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হচ্ছেন জিএম কাদের। গতকাল তাকে দলের কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে দলের পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে ভাইকেই প্রকারান্তরে মনোনয়ন দিলেন এরশাদ। একই দিনে দলটির পরবর্তী সম্মেলন কমিটিও করা হয়েছে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে।
এতে সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। দলে হঠাৎ এ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন মেরূকরণ করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। একই সঙ্গে দলটিতে বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের অনুসারী নেতাদের ক্ষমতা খর্ব করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও মনে করছেন দলটির ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এছাড়া বর্তমান মহাসচিব জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলুকেও সরিয়ে দেয়া হচ্ছে মহাসচিবের পদ থেকে। তবে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে সম্মেলনের মাধ্যমে। এদিকে দলের পরবর্তী কর্ণধার হিসেবে ভাই জিএম কাদেরকে মনোনয়নের বিষয়ে জানিয়েছেন এরশাদ নিজেই। গতকাল রংপুর থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, তার পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হবেন, এটিই তিনি আশা করেন।
এদিকে হঠাৎ করেই দলের এ পরিবর্তনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। গত জাতীয় নির্বাচনে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে আলোচনার কেন্দ্রে আসে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে নানা নাটকীয়তার পর দলটি ৪০ জন সংসদ সদস্য হন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা করা হয়। মন্ত্রিসভায় স্থান পান তিনজন নেতা। একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকায় দলটি নানামুখী সমালোচনার মুখে পড়ে। দেশে বিদেশে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই দলটির নেতাদের কাছে।
রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হওয়ার পর দলের কর্তৃত্ব নিয়েও এরশাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। দলীয় এমপি ও মন্ত্রীরা রওশন এরশাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকলেও দলের বেশির ভাগ নেতা ও তৃণমূল কর্মীরা এরশাদের পক্ষে রয়েছেন। এ নিয়ে এরশাদ বরাবরই হতাশা প্রকাশ করে আসছিলেন। এছাড়া একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার বিষয়েও এরশাদ সময়ে সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দলীয় মন্ত্রীদের পদত্যাগ করারও পরামর্শ দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। এর আগে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়াকে কেন্দ্র করে দলটি একদফা ভাঙনের মুখেও পড়ে। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষে ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। তিনি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষে ছিলেন। এরশাদ নিজেও নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রথমে। নাটকীয়ভাবে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়ার পর রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নেতারা নির্বাচনে অংশ নেন। দলের এ অবস্থায় কাজী জাফর আহমেদ এরশাদকে দল থেকে বহিষ্কার করে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। পরে এরশাদও কাজী জাফরকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। পরে কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলে যোগ দেয়।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি: আগামী এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় সম্মেলন করার লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তুতি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় পার্টি। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ ঘোষণা দেয়া হয়। এতে জিএম কাদেরকে আহ্বায়ক ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে সদস্য সচিব করা হয়। এ কমিটি গঠনের পর বর্তমান কমিটি থাকবে কিনা এ নিয়ে দুরকমের বক্তব্য পাওয়া গেছে নেতাদের কাছ থেকে। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি মানেই এখন মূল কমিটি। এখানে পূর্বের কমিটির কার্যকারিতা থাকার কথা নয়। তবে এরশাদ নিজেই জানিয়েছেন, বর্তমান কমিটি বহাল আছে। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি সম্মেলন আয়োজনে কাজ করবে। যদিও ইতিপূর্বে জেলা কমিটির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির মাধ্যমে ওইসব কমিটির কার্যকারিতা বাতিল করা হয়।
জিএম কাদের কো-চেয়ারম্যান: এদিকে গতকাল রাতে রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, মুক্ত রাজনীতি করতে না পারায়, জনগণের কাছে জাতীয় পার্টির অবস্থান তুলে ধরতে পারিনি। আমি এখনও মুক্ত রাজনীতি করতে পারি না। আমরা কোথায় আছি তা আমরা নিজেরাই জানি না। আমিসহ তিন মন্ত্রী উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিত্বে থেকে কখনোই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায় না। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো আমাকে বিশেষ দূতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিন। অন্য মন্ত্রীদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, আমার অবর্তমানে এ দায়িত্ব পালন করবেন জিএম কাদের। এখন থেকে জিএম কাদের দলের কো- চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। এপ্রিলে জাতীয় পার্টির কাউন্সিল হবে। সেখানে জিএম কাদেরকে আহ্বায়ক করা হবে। আর সদস্য সচিব করা হবে রুহুল আমিন হাওলাদারকে।
জাপা চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমি ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করিনি। আমার মনে অনেক ব্যথা। আমার ওপর যে অন্যায় অত্যাচার করা হয়েছে তা আর কারও ওপর করা হয়নি। তবুও আমি জনগণের ভালোবাসায় বেঁচে আছি। মানুষ এখনও লাঙ্গলের সঙ্গে রয়েছে। কারণ, জাপা ক্ষমতায় থাকাকালে মানুষ শান্তিতে ছিল। কিন্তু এখন সেই শান্তি আর নেই। তিনি বলেন, আমি এখনও মুক্ত রাজনীতি করতে পারি না।
জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, দলে যে আস্থার সংকট হয়েছে তা ফিরিয়ে আনতে চাই। জিএম কাদেরকে সেই কারণেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সে অবশ্যই দলের সবাইকে নিয়ে দলের ইমেজ ও আস্থা ফিরিয়ে আনবে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিতে আমূল পরিবর্তন আনতে চাই, যাতে আগামীতে দলটি জনগণের ভালোবাসা নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারে। সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের, জেলা আহ্বায়ক মোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, সদস্য সচিব হুসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ, মহানগর আহ্বায়ক মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাসহ জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
অস্তিত্ব সংকট: নির্বাচনে বিতর্কিত অবস্থান, পরবর্তীতে দলের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ায় ক্রমে অস্তিত্ব সংকটের দিকে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় নির্বাচনের পর হয়ে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিলেও সাফল্য পায়নি দলটি। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে দলের দৈন্যদশা ফুটে ওঠে। এ নির্বাচনে মাত্র ৯৩টি পৌরসভায় প্রার্থী দিয়ে মাত্র একটিতে জয় পান জাপা প্রার্থী। এছাড়া গত দুই বছরে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। এদিকে সারা দেশে মাত্র ২৭টি জেলায় দলটির কমিটি রয়েছে। বাকি জেলাগুলোতে কোনো কার্যকর কমিটি নেই। বর্তমান কমিটি বারবার এসব জেলায় সম্মেলন করে কমিটি করার কথা বললেও তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ নিয়ে এরশাদ নিজেই বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
(সূত্র-মানবজমিন।)