আজিজ মিয়া রুবেল ।।
সংবাদ ও সাংবাদিক দু‘টি ভিন্ন শব্দ হলেও একটি আরেকটির পরিপূরক। একটি ছাড়া আরেকটি চিন্তাও করা যায় না। একটি আরেকটির সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে, যেমন দেহ ও রক্ত। সংবাদ আসলে কি এমন জিনিস বা এমন কি বিষয়? যার জন্য সারা বিশ্বে এত আলোচনা, সমালোচনা, বাক-বিতন্দ্রা, হাসি -কান্না, জয়- উল্লাস,আহাজারী, ইতিহাস,হুমকি-ধামকি—— ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে সংবাদ সম্পর্কে জেনে নিই এটা আসলে কি?
সংবাদঃ- সংবাদের অভিন্ন কোন সংজ্ঞা নেই। তবে অনেকে বলে থাকে ইংরেজী চার দিকের নামের প্রথম অক্ষর গুলো মিলে সংবাদে শব্দের উৎপত্তি। যেমন- North থেকেN, East থেকে E, West থেকে W, South থেকে S এর সমন্বয়ে News এর উৎপত্তি। আবার অনেকে বলে থাকেন যে, “নতুন কিছু” New Something এর ইংরেজী এর সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে News শব্দের উৎপত্তি যার বাংলা অর্থ সংবাদ বা খবর। অর্থাৎ চারদিকের ঘটে যাওয়া সমস্ত নতুন ঘটনাই সংবাদ। সংবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অনেক গুনী সাংবাদিক বলেছেন- সংবাদ হলো এমন কোন বিষয় যা সাংবাদিকরা লিখতে চান এবং পাঠকরা যার প্রতি আগ্রহ পোষন করেন। আবার অনেকে বলেছেন, সংবাদ হচ্ছে এমন কোন বিষয় যা শুনলে চোখের ভ্রু নড়ে উঠে ও বিবেককে নাড়া দেয়। সংবাদ সম্পর্কে উপরের তথ্য হতে কিছুটা হলেও ধারনা পেলাম যে, সংবাদ আসলে কি? অর্থাৎ সংবাদ কেমন হওয়া চাই তাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছি। কিন্তু বর্তমানে এমন সংবাদ খুব সম্ভবত কম- ই দেখে বা শুনে থাকি। মূলতঃ কেন আমরা এখন আর বস্তু নিষ্ঠ সংবাদ দেখতে , পড়তে ও শুনতে পাইনা তার ও যথাযথ কারন রয়েছে। তার মূল কারন হচ্ছে সাংবাদিক! প্রিয় পাঠক লেখার শুরুতেই লিখেছিলাম দেহের সাথে রক্তের যেমন সম্পর্ক ঠিক তেমনি সংবাদের সাথে সাংবাদিকের সম্পর্ক । কারন খোজার আগে আমরা এখন সাংবাদিক সম্পর্কে একটু জেনে নেব মূলত সাংবাদিক কাকে বলে বা সাংবাদিক বলতে আমরা কি বুঝি?
সাংবাদিকঃ উপরের একটি সংজ্ঞাতে লিখেছিলাম সংবাদ হলো এমন কোন বিষয় যা সাংবাদিকরা লিখতে চান এবং পাঠকরা পড়তে আগ্রহ পোষন করে। এই সংজ্ঞাটি বিশ্লেষন করে আমরা বলতে পারি যে, সাংবাদিক হচ্ছে একজন লেখক, যিনি এমন সংবাদ লেখেন যা পড়তে পাঠকরা আগ্রহ পোষন করে। অন্য কথায় বলা যায়, যিনি সংবাদ সংগ্রহ করে সুবিন্যস্ত ভাবে পরিবেশন করেন তাকে সাংবাদিক বলে। উপরোক্ত সকল আলোচনার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষনের সারমর্ম হিসাবে সাংবাদিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আমরা নিদ্বিধায় বলতে পারি যে সাংবাদিক হল আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী যা স্বচক্ষে অবলোকন করে যিনি সম্পূর্ণ বস্তনিষ্ঠতা বজায় রেখে যথাযথ প্রমান স্বাপেক্ষে পাঠক সমক্ষে পরিবেশন করেন। সাংবাদিক সম্পর্কে কিছুটা ধারনা বোধ করি, দিতে পেরেছি। এখন কারনটা বলি, কেন সাংবাদিকের এমন দূরাবস্থা। অথাৎ বর্তমান সময়ের সংবাদ গুলো বস্তুনিষ্ট ও পাঠক নন্দিত হচ্ছে না । তার মূলকারন হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা । হলুদ সাংবাদিকরা কখনই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনা। যাই হোক আজকের বিষয় হচ্ছে “বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবাদ ও সাংবাদিক” তাই ও প্রসংজ্ঞে আর বাড়তে চাচ্ছি না । কথায় আছে যেমন কর্ম তেমন ফল। আমি এই কথাটির সাথে তাল মিলিয়ে বলতে চাই , যেমন সাংবাদিক তেমন সংবাদ। অর্থাৎ সাংবাদিকের যেগ্যতা , অভিজ্ঞতা ও কলাকৌশলের উপর সংবাদ যর্থাথ বস্তুনিষ্ঠতা পাবে এবং পত্রিকাটি ও পাঠক নন্দিত হবে।
মূলকথাঃবাংলাদেশের সংবাদ পত্রের অনলাইন তালিকা অনুযায়ী দেখা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দু‘হাজারের ও অধিক পত্রিকা রয়েছে। এর মধ্যে বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা প্রায় শতাধিক। জেলাওয়ারী আঞ্চলিক পত্রিকার সংখ্যা পাঁচ শতধিক । সাপ্তাহিক, পাক্ষিক , মাসিক ও ষন্মাসিক পত্রিকার সংখ্যা দুই শতাধিক। ম্যাগাজিন অর্ধশতাদিক এবং অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এছাড়াও ৪১টি টিভি চ্যানেল, ২৪টি এফ এম এবং ৩২ টি কমিউনিটি রেডিও বর্তমান চালু আছে। যার ফলে সাংবাদিক বেড়েই চলছে কিন্তু বাড়ছে না সাংবাদিকদের কর্মদক্ষতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আজকাল দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠছে। যে কারনে দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত ও প্রতিভাবানরা এখন এ পেশায় আর আসতে চায়না । শুধু এ কারনটিই নয় আরো অনেক কারন রয়েছে, যার কারনে সাংবাদিকতা পেশাটিকে মানুষ এখন আড় চোখে দেখে এবং প্রতিভাবানরা এ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সংবাদের মান এবং মানুষ ক্রমেই সংবাদ পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে সাংবাদিকদের মধ্যেও রয়েছে দলাদলি, হিংসা , বিদ্বেষ। বলা বাহুল্য দেশের কথিত সাংবাদিকরা আজ কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে সার্থ সিদ্ধি করে উপরে উঠে গিয়েছেন। সাংবাদিক মানে জাতির বিবেক কিন্তু বর্তমানে সাংবাদিকদের বিবেক কত টুকু আছে এটা ঐসকল সাংবাদিকদের কাছে আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন? তবে এখনো অনেক সাংবাদিক আছে যারা সত্যিই জাতির বিবেক। তাদের কারনেই আজ ও সংবাদ মাধ্যম গুলো বেঁেচ আছে। এখনো মানুষ সংবাদ পত্র পড়ে, খবর দেখে ও শুনে। কিন্তু সাংবাদিকদের অবস্থা ক্রমেই এরূপ হতে থাকলে একদিন হয়তো সত্যিকারের যারা সাংবাদিক তাদেরকে এমহান পেশায় আর পাওয়া যাবে না । মানবতার কল্যানে মহান এ পেশাটি কলুসিত হতে থাকবে । সাংবাদিক গন হারাবে তাদের মান সম্মান, খাবে রাস্তা ঘাটে মার , হবে নির্যাতিত। এখন প্রায় খবরের কাগজ হাতে নিতে না নিতেই দেখা যায় সাংবাদিক নির্যাতিত হচ্ছে, মার খাচ্ছে। আর এই সবের মূল কারন-ই হচ্ছে সাংবাদিকদের দলে দলে বিভক্ত হওয়া ও যোগ্য সাংবাদিগের অল্পতা। ফলে এক দল সাংবাদিক মার খাচ্ছে, আরেক দল সাংবাদিক দেখে খিলখিলিয়ে হাসছে। এই হলো দেশে বাক স্বাধীনতা ও স্বাধীন পেশা সাংবাদিকতার চিত্র। সংবাদ ও সাংবাদিক আজ অনেকাংশেই সন্ত্রসীদের কাছে জিম্মি । প্রায় প্রতিদিন-ই সাংবাদিক নির্যাতনের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন- গাজীপুরে সাংবাদিক আমির হোসাইনকে হুমকি দিয়েছে সন্ত্রসী সেলিম( দৈনিক মুক্ত বলাকা ২২ এপ্রিল২০১৪ইং) , জবিতে সাংবাদিকের উপর হামলাঃ আহত ৬ (দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২৫ আগস্ট ২০১৪ইং), সাংবাদিক অখিল পোদ্দারকে নির্যাতনকারী এ এস আই বরখাস্ত ( মানব জমিন ২৮ আগস্ট ২০১৪), ঢাবিতে সাংবাদিক মারধরের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের মানব বন্ধন ( দৈনিক প্রভাত ৫ সেপ্টম্বর ২০১৪), কালীগঞ্জে সাংবাদিকদের উপর হঠাৎ চড়াও আ.লীগ সম্পাদক গনি ভূইয়া ( দৈনিক মুক্ত বলাকা ২৯ অক্টোবর ২০১৪), সাংবাদিক নির্যাতনে এগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ( দৈনিক ফলাফল ৪ মে ২০১৫), এক বছরে ২১৩ সাংবাদিক নির্যাতন, খুন চার জন ( দৈনিক ইত্তেফাক ৪ মে ২০১৫) , সাংবাদিককে জীবন নাশের হুমকি থানায় জি ডি ( সাপ্তাহিক রেসকোর্স ১১ জানুয়ারী ২০১৫), সাংবাদিককে প্রথমে প্রাণনাশের হুমকি পরে হত্যার চেষ্টা পিরুজালীতে গ্রেফতার -১ (সাপ্তাহিক ঘটনার আড়ালে ৬ জুলাই ২০১৫), নারী সাংবাদিক উত্ত্যক্তকারী ট্রাম্প ( বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ ফেব্র“য়ারী ২০১৬) যৌন হয়রানির অজ্ঞিতা জানালেন নারী সাংবাদিক (প্রথম আলো ৮ ফেব্র“য়ারী ২০১৬) আশিয়ান সিটি নিয়ে সংবাদ রূপগঞ্জে অস্ত্র ঠেকিয়ে সাংবাদিককে হত্যার হুমকি ( বাংলাদেশ প্রতিদিন ৯ ফেব্র“য়ারী ২০১৬)। এছাড়াও বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রবির সিকদার এর নির্যাতনের কথা আমরা সকলেই অবগত। এভাবেই সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত নির্যতিত হচ্ছে পুলিশ, সরকারীদল ও বিরোধীদলীয় ক্যাডাদের হাতে, দেশে ও দেশের বাইরে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন তা নিয়ন্ত্রনেরও কোন উপায় থাকবেনা। সংবাদ পত্রের কন্ঠরোধ হলে রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বড় ক্ষতির সমক্ষীন হতে হবে। তার কারন সংবাদ পত্রের মাধ্যমে বা সংবাদের মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্র জানতে পারে যে, দেশের কোথায় কোন ধরনের সমস্যা হচ্ছে। আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে সমস্যটি কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
সাংবাদিক ভাইদের প্রতি দু‘টি কথাঃ- সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। চ্যালেঞ্জের পাশা পাশি সাংবাদিকদের থাকতে হয় মানবিক মূল্যবোধ, আদর্শ, ন্যায়-নীতি, সত্যবাদিতা ও সাহসীকতা। এ গুনাবলী যতক্ষন পর্যন্ত একটি সাংবাদিকের মধ্যে পাওয়া না যাবে ততক্ষন পর্যন্ত সে সমাজে অবহেলিত ও নির্যাতিত হবে। তাই সব সময় নিজের পেশার গুনগত মান ধরে রাখার চেষ্টা করুন। অর্থের লোভে পরে অথবা ভয়ে নিজের ণীতি ও আদর্শকে বির্সজন দিবেন না। কথায় আছে অসির চেয়ে মসির শক্তি বেশী। তবে মসি যখন ক্ষুরধার হয়ে উঠে তখন সেই বিধ্ব্ংসী শক্তির পরাজয় ঘটে। কিন্তু মসি যতদিন কার্যকর ভূমিকা গ্রহন না করে ততদিন অসির দাপট ও দৌরাত্ম্য সিমাহীন। এটা সাধারন ভাবে যেমন সত্য তেমনি ক্ষুরধার পরিসরে প্রযোজ্য।