।।রফিকুজজামান রুমান।।
বাংলাদেশের মতো “রাজনীতি-প্রিয়” দেশে কী ভয়ানকভাবে রাজনীতি-বিমুখতা বিরাজমান! এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের “অরাজনৈতিক” সময়েও এমন রাজনীতি-শূন্যতা ছিল না। এবং কী আশ্চর্য, অধিকাংশ মানুষ এই সময়টাকেই কেমন সহজভাবে মেনে নিয়েছে! উন্নয়নের বিবৃতি-বয়ানের কাছে পরাজিত গণতন্ত্র দেখে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও আড়ালে আবডালে মুচকি হাসেন হয়তো। বর্তমান সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় “নির্বাচিত” ১৫৪ জন সংসদ সদস্যের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিতব্য ৭৩৮টি ইউনিয়নের ৬৬টিতেই সরকারদলীয় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত! ইউনিয়ন পরিষদ দেশের জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান। রাজনীতির বাইরেও এর সঙ্গে জনগণের একধরনের “অংশগ্রহণগত” সম্পর্ক রয়েছে। সেখানেও ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ রইলো না। এসবের সরল তাৎপর্য হলো এই, আসলে রাজনীতি না চললে কিছুই ঠিকভাবে চলে না। উন্নয়ন, গণতন্ত্র, নির্বাচন, এমনকি সাংবাদিকতাও- সবকিছুরই গতি-প্রকৃতি ঠিক করে দেয় রাজনীতি। আলাদা করে সাংবাদিকতার কথাই বলা যাক। কেমন চলছে প্রায় রাজনীতি-শূন্য বাংলাদেশের বর্তমান সাংবাদিকতা?
সেই বিশ্লেষণে যেতে হলে রাজনীতি-চর্চার ক্ষমতার পাঠটি বুঝতে হবে। আমাদের মতো দেশে রাজনীতি হলো সীমাহীন ক্ষমতার প্রতীক। আর কে না জানে, ক্ষমতা অসীম হলে তার প্রতি লোভও হয় সীমাহীন! এই ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে খুবই কমসংখ্যক ব্যক্তির হাতে। আমেরিকার মতো দেশেও, বিখ্যাত অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি তাঁর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের সে দেশের পলিসি মেকিং-এ কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশে অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। জনগণের অংশগ্রহণ কম হলেই ক্ষমতার লাগাম শক্ত হয়। জনগণকে অন্ধকারে রাখতে পারলেই ক্ষমতা-চর্চার পথ প্রশস্ত হয়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্যামুয়েল হানটিংটন সেকথাই বলেছেন, Power remains strong when it remains in the dark. Exposed to sunlight, it begins to evaporate.ক্ষমতা-সর্বস্ব রাজনীতির তাই কৌশলই হলো জনগণকে দূরে রাখা। জনগণকে অন্ধকারে রাখা। আর ক্ষমতা একবার পাকাপোক্ত হয়ে গেলে এবং সেটির আপাত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে রূপ নেয় তা স্বেচ্ছাচারিতায়। সুশাসন নির্বাসনে যায়। দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত হয়। কোনোকিছুই আর ঠিকভাবে চলে না। রাষ্ট্রের “চতুর্থ স্তম্ভ” হয়ে এসব ধরিয়ে দিবে যে গণমাধ্যম, সেটিও হারিয়ে ফেলে পথ। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কি পথ হারিয়েছে?
কেউ বলেন, পথ হারিয়েছে। কেউ বলেন, ঠিক পথ হারায়নি; গতি হারিয়েছে। যদিও একটার পরে একটা টিভি চ্যানেল আসছে। পত্রিকার সংখ্যা বাড়ছে। এতগুলো গণমাধ্যমের মধ্যে “মাত্র” তিনটি চ্যানেল আর একটি সংবাদপত্র সিলগালা করা হয়েছে। অনেকেই বলছেন, গণমাধ্যমের উপরে কোনো চাপও নেই। মানবজমিনের প্রধান সম্পাদকই তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, এখন আর “কোনো টেলিফোন বাজে না। বলা হয় না এই রিপোর্ট যাবে, এই রিপোর্ট যাবে না।” তবে কি বাংলাদেশে চাপহীন মুক্ত সাংবাদিকতা চলছে? হাত-পা বাঁধা নেই। চোখও খোলা। তার মানেই কি আপনি একজন স্বাধীন মানুষ? খোলা চোখ দিয়ে কী দেখা যাবে, কতোটুকু দেখা যাবে- সেই প্রান্তসীমা যদি নির্ধারিত করে দেয়া হয়, তবে সেটি স্বাধীন সাংবাদিকতা নয়। তার চেয়েও বড় যে সমস্যাটি বাংলাদেশের বর্তমান সাংবাদিকতায় বিরাজমান তা হলো “সেলফ সেন্সরশিপ”। রাষ্ট্রের/সরকারের/প্রশাসনের “বডি ল্যাঙ্গুয়েজ” বুঝতে পেরে সেই অনুসারে “ঝামেলাহীন” সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। প্রধান সম্পাদক যেটিকে বলেছেন, সিদ্ধান্ত নিতে হয় “প্রায় দুইশ স্টাফের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।” ফোন না আসলেও প্রধান সম্পাদক/বার্তা সম্পাদকরা এখন বুঝতে পারেন কী ছাপানো যাবে, কী যাবে না। সাংবাদিক চাকরি হারাতে চান না। সম্পাদক/মালিক চান না পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাক। তাই নানা কারণে নানা প্রয়োজনে আপসকামিতাই হয়ে দাঁড়ায় অনিবার্য।
তাহলে সাংবাদিকতার এথিক্স? রাজনীতি আর ক্ষমতার যাঁতাকলে সে আজ বিপন্ন প্রায়। গণমাধ্যমের কোনো পক্ষ থাকতে হয় না। একজন সাংবাদিক সত্য তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সেটি করতে গিয়ে মুদ্রার অন্য দিকটিও তাকে দেখতে হবে। একজনকে বলে দেয়া হলো সে সন্ত্রাসী/জঙ্গি, অথচ তার কোনো বক্তব্য নেয়া হলো না। এটি ভালো সাংবাদিকতা না। এ বিষয়ে সংবাদ সংস্থা এপি’র একটি নীতি আছে- Good reporters get the facts right. They seek comment from all sides. They check. They don’t cut corners. পুলিশের/র্যাবের হেফাজতে থাকা “অপরাধীদের” যে বক্তব্য সংবাদ সম্মেলন করে দেয়া হয়, সেটি প্রচার করার মাধ্যমে এই নীতিমালা লঙ্ঘন করে গণমাধ্যমগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত মানবাধিকার কর্মী ও মন্ত্রী ম্যালকম এক্স বলেছিলেন, If you are not careful, the newspapers will have you hating the people who are being oppressed, and loving the people who are doing the oppression. বাংলাদেশের সঙ্গে কী চমৎকারভাবেই না মিলে যায় এই চিত্রটি! আপনি যদি খুব সতর্ক না হন, দেখবেন- সংবাদপত্র (গণমাধ্যম) তাদেরকেই ঘৃণা করতে শেখাবে যারা নির্যাতনের/অত্যাচারের শিকার। আর তাদেরকেই ভালোবাসতে/সমর্থন করতে শেখাবে যারা নির্যাতনকারী।
কোনো পক্ষকে প্রতিপক্ষ বানানো সংবাদমাধ্যমের কাজ না। “যে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা” নীতি সাংবাদিকতার জন্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬তম প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন আপসোস করেই বলেছিলেন, যদি কোনোদিন দেখা যায় যে, আমি পটোম্যাক নদীর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, সংবাদপত্রগুলো লিখবে, “প্রেসিডেন্ট সাঁতার জানেন না!” সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার সততা ও নৈতিকতা একজন সাংবাদিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সত্য বলা আর মিথ্যাকে ঘৃণা করার চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না। তা নিজের বা কোনো পক্ষের ক্ষতির কারণ হলেও। একজন সাংবাদিককে সাংবাদিকতা
করার সময়টিতে নিজের সমস্ত ভালোলাগা/সমর্থন/মতামত যতটা সম্ভব বিসর্জন দিতে হয়। হোয়াইট হাউস কাভার করা সিবিএস নিউজ- এর সাংবাদিক ড্যান র্যাদার তাঁর Camera Never Blinks বইয়ে লিখেছেন, “প্রতিদিন যখন আমি খবর সংগ্রহ করার জন্য হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করি, আমি আমার ব্যক্তিগত আবেগ (ভালোলাগা/সমর্থন/মতামত) হোয়াইট হাউসের বাইরে রেখে আসি।” তিনি বলেন, job is to inform, not persuade. বাংলাদেশের সাংবাদিকতার চর্চায় এই দিকটি এখনও মানোত্তীর্ণ নয়। এখানে রিপোর্টাররা অনেক সময়ই সাপোর্টার হয়ে যান। একজন সংবাদকর্মী নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে প্রায় সবকিছুই রাজনীতিময়, সেখানে পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে থেকে সাংবাদিকতা করা সহজ নয়। কিন্তু এই রাজনৈতিক আদর্শ/বিশ্বাস তার প্রতিবেদনে/সংবাদ লিখনে প্রতিফলিত হওয়া অন্যায়। কিছু লোক কোনো একটি জায়গায় বসে মিটিং করছিল। “গোপন” সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। উদ্ধার করে “জিহাদি” বই। সংবাদমাধ্যমে বলা হলো- নাশকতার পরিকল্পনাকারীদের জিহাদি বইসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা যে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল সেটি সাংবাদিকরা নিশ্চিত হলো কীভাবে? একপক্ষের (পুলিশের) বক্তব্য দিয়েই কি একটি প্রতিবেদন সম্পূর্ণ হয়? দেশের সাংবাদিকতায় জিহাদি বই একটি ‘টার্মিনোলজি” হয়ে গেছে! ধর্মীয় বই মানেই জিহাদি বই! একটি বইয়ে কী লেখা থাকলে সেটি “জিহাদি” বই, আর কী না থাকলে “জিহাদি” বই নয়, তা নির্ধারণ করে দেবে কে? একপক্ষের বক্তব্য শুনে তা যাচাই বাছাই না করে যদি সংবাদ লেখা যায়, তাহলে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তো কোনো অন্যায় করেননি। এসবই রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। সাংবাদিকরা রাজনীতি করেন বলে রাজনীতিবিদরাও মাঝেমধ্যে সাংবাদিকদের রাজনীতি শেখান!
মূল সমস্যাটা আসলে স্বআরোপিত। কিংবা বলা যায় নিজের ভেতরে লালন করা রাজনৈতিক পক্ষপাত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা নিজের ধারণার বৃত্ত ভেদ করে বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেন না। রাজনৈতিক বিশ্বাস/আদর্শ/পক্ষপাতের প্রতিফলন ঘটে ঘটনার বর্ণনায়। সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ জোসেফ পুলিৎজার সে কথাই বলেছেন, For the most part we do not first see, and then define, we define first and then see. সাংবাদিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনা অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্তে আসেন না, বরং সিদ্ধান্ত নিয়ে (সেই অনুসারে) ঘটনা দেখেন। ফলে সাংবাদিক তা-ই “খুঁজে” পান যা তিনি ধারণা করেছেন। এতে সত্য চাপা পড়ে যায়। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জায়গা দখল করে নেয় ধারণা-নির্ভর সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতায় একটি প্রাচীন প্রবাদই আছে এরকম- If your mother tells she loves you, check it out! এই “চেক” সাংবাদিকতায় অপরিহার্য।
রাজনীতির কাছে গণমাধ্যম হেরে গেলে আসলে হেরে যায় জনগণ। জনগণের পরাজয় মানে রাষ্ট্রের পরাজয়। তাই গণমাধ্যমকে সঠিক পথে চলতে দিতে হবে। গণমাধ্যমকেও সঠিক পথটি চিনে নিতে হবে। বাইরের রাজনীতির পাশাপাশি নিজের ভেতরের রাজনীতির মোহমুক্ত হয়ে সাংবাদিকতা করতে পারলেই সেটি সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে।
রফিকুজজামান রুমান
শিক্ষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি