৫২ রাজনীতি ডেস্ক।।
সব দলের অংশগ্রহণে যথাশীঘ্র একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের সঙ্গে সপ্তাহব্যাপী হরতালের পর অসহযোগ আন্দোলনের চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। সারা দেশে একযোগে এ কর্মসূচি পালন করা হবে। যেখানে বাধা সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে- এমন বার্তাই নেতা-কর্মীদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সরকার নতুন নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ না নিলে চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনেই চলে যাবে বিএনপি জোট। এর মধ্যেই রাজধানীসহ সারা দেশে গণজমায়েতের পরিকল্পনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে চলমান অবরোধের সঙ্গে রবিবার থেকে শুরু হওয়া ৭২ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি আরও ৩৬ ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। তবে শুক্রবার অবরোধ চললেও হরতাল না রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর আত্দার মাগফিরাত কামনায় আজকের মিলাদ ও বিশেষ দোয়া মাহফিল কর্মসূচি শুক্রবার নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিনকে বাইরে রেখে ফের শনিবার থেকে হরতাল কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছেন বিএনপি জোটের নীতিনির্ধাকরা।
জানা গেছে, অসহযোগের সঙ্গে গণজমায়েতের বিষয়ে পুলিশ বা অন্য কোনো প্রশাসনের অনুমতি চাইবে না ২০ দল। যেখানে বাধা সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে- এমন বার্তাই নেতা-কর্মীদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপে সব ধরনের কর্মসূচি পালনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন খালেদা জিয়া।
জানা গেছে, এক দফার অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে তা বাস্তবায়নে আরও কঠোর নীতি অবলম্বন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাকে সারা দেশ থেকে জল, স্থল ও রেল পথে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এর আগে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে আন্দোলনে আরও গতি বাড়ানো হবে। আন্দোলন কর্মসূচিতে আরও পরিবর্তনও আসবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলতেই থাকবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা হরতাল : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল এক বিবৃতিতে আরও ৩৬ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, নেতা-কর্মীদের খুন-গুম, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ, বেগম খালেদা জিয়া এবং দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সব নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করার প্রতিবাদে সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি চলমান ৭২ ঘণ্টার ‘শা?ন্তিপূর্ণ’ হরতাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাড়ানো হলো।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে যে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একের পর মামলা দিচ্ছে। সোমবারও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলা থেকে বাদ যায়নি বিএনপি-সমর্থক পেশাজীবীরাও। রোববার রাত গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে।
গুলশানে প্রজন্ম লীগের বিক্ষোভ : এসএসসি পরীক্ষার ভিতর চলমান অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবিতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় ঘেরাওয়ের চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ‘প্রজন্ম লীগ’। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গতকাল বেলা পৌনে ১২টায় গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে যাওয়ার পর পুলিশের বাধায় সেখানে অবস্থান নেন। পরে সেখানে পুলিশি বেষ্টনীতে তারা বিক্ষোভ করেন। এতে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের সভাপতি ফাতেমা জলিল সাথী ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন। এদিকে ২০-দলীয় জোটের নেতা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিম বীরপ্রতীক বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে গতকাল সন্ধ্যায় গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের সকল গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক জনতা ঐক্যবদ্ধ। সংবিধান স্বীকৃত সকল মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, জনপ্রতিনিধিত্ত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা ও ভোটারবিহীন জবরদখলকারী অবৈধ সরকারের পতনের লক্ষ্যে চলমান গণআন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত প্রায়।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতো, মুখে সংলাপের কথা বললেও সরকার দিন দিন কঠোর হচ্ছে। গত কয়েক দিনের দলের জ্যেষ্ঠ দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ২০ ঘণ্টা পর ফের সংযোগ দেওয়া হয়। তবে সংযোগ দেওয়া হয়নি ডিশ, ইন্টারনেট ও টেলিফোনের। এ অবস্থায় বিএনপির ভাষায় আন্দোলনের গতি আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
সময় যত বাড়ছে, গ্রেপ্তারের তালিকা ততই দীর্ঘ হচ্ছে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যারাই প্রকাশ্যে আসছেন, সরকার তাদেরই গ্রেপ্তার করছে। এর ফলে বিএনপি নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। আত্মগোপনে থেকেই তারা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। এ অবস্থায় সারা দেশে চলছে নাশকতা। বড় দুই দলই এ নাশকতার জন্য পরস্পরকে দুষছে।
বিএনপির এক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, ২০-দলীয় জোট বুধ ও বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকলে শুক্রবার জামায়াত ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডাকতে পারে। অবরোধের মধ্যেই এ কর্মসূচি চলবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে জে (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মিথ্যা’ অভিযোগে একের পর এক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে দেশকে কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেও আন্দোলন দমানো যাচ্ছে না।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের সকল গণতন্ত্রকামী দেশপ্রেমিক জনতা ঐক্যবদ্ধ। সংবিধান স্বীকৃত সকল মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, জনপ্রতিনিধিত্ত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা ও ভোটারবিহীন জবরদখলকারী অবৈধ সরকারের পতনের লক্ষ্যে চলমান গণআন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত প্রায়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
অবরোধ ডেকে গাড়িতে আগুন দিয়ে ৪২ জনকে পুড়িয়ে হত্যা ও নাশকতার অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে। খালেদা জিয়া ছাড়াও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে। গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী দ-বিধির ৩০২, ১০৯ ও ১২০(বি) ধারায় ঢাকা সিএমএস আদালতে মামলাটি করেন। পরে বেলা ১১টার দিকে শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমান গুলশান থানার ওসিকে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। বাদীপক্ষে অ্যাডভোকেট রওশন আরা সিকদার ডেইজি ও আবুল কালাম আজাদ মামলা পরিচালনা করেন।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে মামলার অভিযোগে বলা হয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের চলমান অবরোধ ও হরতালে গত ৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৪২ জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে গত ২৭ জানুয়ারি ট্রাকচালক আবদুর রহমান ও বকুল দেবনাথ, ১৩ জানুয়ারি আড়াই বছরের শিশু সাফির, জেসমিন আক্তার, ১৫ জানুয়ারি স্কুলছাত্র রাজন আলী, বাসচালকের সহকারী তোফাজ্জল ও ট্রাকচালকের সহকারী সোহাগ বিশ্বাস রয়েছেন। ওই হত্যাকাণ্ডের দায়ভার অবরোধ ও হরতাল আহ্বানকারী ২০-দলীয় জোটের প্রধান বিএনপি-নেত্রী খালেদা জিয়া এবং অন্য ৩ আসামির ওপর বর্তায়। অন্যদিকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ও হরতাল দিয়ে মানুষ হত্যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের মধ্যেও পড়ে।
বিএনপির এবারও ঢাকার নেতারা ব্যর্থ এই বিষয়টি খালেদা ও তারেক কেমন করে মূল্যায়ন করছেন জানতে চাইলে খালেদার ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, নেতারা গুলির মুখে দাঁড়াতে পারছেন না। গুলির মুখে দাঁড়িয়ে আন্দোলন সফল করা যায় না। এটা করার জন্যতো দাঁড়াতে হবে। সেটাই দিচ্ছে না। তবে ঢাকায় এবার সাফল্য আসুক বা না আসুক বিএনপির আন্দোলন সফল হবে। তারা ঢাকার নেতাদের মাঠে দেখতে চান।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা ছিল সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করানোর জন্য। সমঝোতার জন্যও চেষ্টা ছিল। কিন্তু সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার পর কয়েকদফা আলোচনা হলেও পরে আবার সাফল্য আসেনি। তারানকো যেখানে আলোচনা রেখে গিয়েছিলেন এরপর দুই দলের সিনিয়র নেতা বসে কেবল লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দুই দলের নেতারা বলেছিলেন নীতি নির্ধারক পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
কিন্তু এর আর কোন ফল দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। একবছর ধরেই আন্তর্জাতিক মহল ওই নির্বাচন নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে। আর সংলাপের তাগিদ দিয়ে আসছে। সরকার এটাকে কোন গুরুত্বই দিচ্ছে না। তারপরও তারা থেমে নেই। চলমান আন্দোলনের মধ্যেও সংলাপের জন্য বলে আসছেন।
সারাদেশে ট্রেন, বাসসহ যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা চলছেই। এ দিকে ৭২ ঘণ্টার হরতাল শেষ হতে না হতেই ফের বুধবার থেকে ৩৬ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিলো ২০ দলীয় জোট। চলমান এ হরতাল চলবে আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পালন করবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট।
কোকোর মৃত্যুতে দোয়া মাহফিল শুক্রবার : বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে আগামী শুক্রবার বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। বাদ জুমা সারা দেশে এ কর্মসূচি পালিত হবে। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দোয়া মাহফিল কর্মসূচির কথা জানিয়েছে চেয়ারপারসনের প্রেস উইং।