৫২ শিক্ষা ও সাহিত্য ডেস্ক।।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। দু’মেরুতে অবস্থানে থাকা ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট পরস্পরকে ঘায়েল করতে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে আসছে । তবে বলা যায়- গেল ছয় বছরে রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগের দিক থেকে বরাবরই হাসিনা সরকার অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তবে সহজেই বলতে পারি- নানা বিতর্কের মধ্যেও গেল বছরের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতির দৃশ্যপটে অনেকটাই পরির্তন আসে । নির্বাচনের আগে দেশে যে সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করছিল সেই অবস্থা থেকে দেশবাসী অনেকটাই পরিত্রাণ লাভ করেছিল। যদিও দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই চলে আসছিল। এছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীনরা দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিকভাবে যে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছিল দৃশ্যতঃ তারা সেই চাপও সামলিয়ে উঠেছিল।
নির্বাচনের আগে মহাজোটের পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলা হলেও পরবর্তীতে সেটা ভুলে গিয়ে ৫ বছরের জন্যই ক্ষমতার মসনদে নিজেদের টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টারত তারা। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ ক্ষমতার মসনদ দখলে এক বছরের মাথায় পুনরায় লাগাতর আন্দোলন শুরু করেছে।
৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ আর ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালন করতে গিয়েই দু’পক্ষে রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এতে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকেই সরকার পক্ষ সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে বিরোধী জোট নেত্রীকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। আর বিরোধী পক্ষ ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালন করতে না পারায় ৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতর অবরোধের ঢাক দেয়। সেই সাথে চলছে হরতাল-ধর্মঘট।
পরস্পর বিরোধী অবস্থানে গোটা দেশ আজ কার্যত অচল । বোমা-পেট্রোলের আগুনে জ্বলছে যানবাহন, পুড়ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, বোমায় জলসে হতাহত হচ্ছে শত শত মানুষ। মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে চলছে দগ্ধ মানুষের আহাজারি। এসব ঘটনার জন্য পরস্পরকে দায়ি করা হচ্ছে। অন্যদিকে চলছে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড। পেট্রোল বোমায় পুড়ে এবং বন্দুকযুদ্ধের নামে ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছে। কোনো মতেই যেন এসব কিছু থামছে না। এরফলে ঘরে-বাইরে কোথাও আজ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি, লেখাপড়া সব কিছুই বন্ধ হয়ে গেছে।রাজনীতির ছোবলে গোটা দেশবাসী যেন আজ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এরপরও চলমান এই সহিংসতার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৭ দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু ৩৩ দিন পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আরো বেশী অবনতি হচ্ছে।
প্রায় প্রতিদিনই পেট্রোল বোমায় মারা যাচ্ছে নিরীহ বাস যাত্রী, চালক-হেলপার। এজন্য পরস্পরকে দায়ি করা হলেও প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এদের নাম দেয়া হয়েছে দুর্বৃত্ত। ফলে সহজে চিহ্নিতও হচ্ছে না এসব অপরাধীরা। অন্যদিকে বিরোধী জোটের নেতাকর্মিদের গ্রেফতার এবং গ্রেফতারের পর বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভুত হত্যা করা হচ্ছে বলে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। আর এসব হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এতে পরিস্থিতি ক্রমেই বেসামাল হয়ে উঠেছে। বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
এরই মধ্যে ২ জানুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবার কথা ছিল। তা হয়নি। শুক্রবার-শনিবার ছুটির দিনে দুটি পরীক্ষা নেয়ার সম্ভব হলেও রোববার থেকে পুনরায় ৩ দিনের হরতাল আহবান করা হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা চরম উতকণ্ঠায়।
বলা যায়- রাজনীতিবিদদের একগুয়েমিতে দেশ আজ গভীর সংকটের নিমজ্জিত। সংকটের গভীরতা বিবেচনায় ‘পরিস্থিতি এমন যে, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার পথে চলছে।’ আবার কেউ কেউ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন।
চলমান রাজনৈতিক সংকট দ্রুত সমাধান হোক এটা সাধারণ মানুষের একান্ত চাওয়া সত্ত্বেও সেটার কোনো প্রতিফলন হচ্ছে না। বরং রাজনীতির হানাহানিতে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য মতে, জানুয়ারি মাসেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৬ জন নিহত ও ১৯৪৬ জন আহত হয়েছেন। এদের মধে হরতাল ও অবরোধের সময় পেট্রোল বোমা হামলা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে ২০ জন নিহত ও ২৬০ জন আহত হয়েছেন। ১৭ জন বিচারবহির্ভত হতাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
ফলে এসব হত্যাকে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না। তবে এসব ঘটনা যে শুধু এই সরকারের আমলেই ঘটছে তা বলার সুযোগ নেই। অতীতে যেমন রক্ষিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ সৃষ্টি করেছিল, তেমনি বিগত বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে র্যাব-চিতা ও কোবরার নামে এলিট ফোর্স সৃষ্টি করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথকে সুপ্রশস্ত করে। ফলে কোনো রাজনৈতিক দলই এর দায় এড়াতে পারে না।
ফলে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কতটা নাজুক। এখানে মানুষের জানমালের স্বাভাবিক নিরাপত্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার অধিকারের বিষয়টি অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধীজোট সংলাপের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। অন্যদিকে সরকার ক্ষমতার মসনদ ঠিক রাখতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শক্তি প্রয়োগ করছে। ফলে দৃশ্যত: দুপক্ষই ‘বাঁচা মরার লড়াইয়ে’ লিপ্ত হয়েছে।এতে বলা যায়- জেদাজেদির এই রাজনীতিতে কোনো এক সময় এক পক্ষকে হারতেই যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর কোনো পক্ষ হেরে গেলে যে- তাদের অস্তিত্ব কতটা হুমকির মুখে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। এতে দেশের পরিস্থিতি উন্নতি না হয়ে বরং আরো অবণতির আশঙ্কা রয়েছে। যেটা আলোচনার মাধ্যমে এখনো এড়ানো সম্ভব।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘ সাত বছর আন্দোলন সংগ্রামের ফসল গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপির নেত্বাধীন জোট। ফলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের অর্ধেক নেতাকর্মিই হারিয়ে গেছেন। তারা আর কর্মসূচীতে অংশ নেন না। ফলে চলমান এই আন্দোলনে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে কোনো কারণে ব্যর্থ হলে আরো ২৫ শতাংশ নেতাকর্মি স্বল্প সময়ের মধ্যেই হারিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ । ফলে বলা যায়- বর্তমানে অনেকটাই সঙ্কটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে বিরোধী পক্ষ।
অন্যদিকে কোনো কারণে চলমান আন্দোলন মোকাবেলা করে ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে না পারলে যে, মহাজোটের নেতাকর্মিদেরকেও চরম মাসুল দিতে হবে, তাদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে এতেও কোনো সন্দেহ নেই।
আর যদি ক্ষমতাসীনরা কোনো কারণে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করে মসনদে টিকে যেতে পারে তবে নি:সন্দেহে বলা যায় সহসাই আর ক্ষমতার পরিবর্তন হবে না। এর মধ্যে যদি দৈববশত কোনো ধরনের অঘটন না ঘটে। আর এতে ক্ষমতাসীনদের এই শাসন হতে পারে তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের শাসনের মতো ১৫ বছর জন্য, হতে পারে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মত ২৩ বছর, হতে পারে মিশরের হোসনি মোবারকের মতো ৩০ বছর ও লিবিয়ার গাদ্দাফির শাসনের মতো দীর্ঘ ৪১ বছরের জন্য। তবে চলমান আন্দোলন মোকাবেলা করা ক্ষমতাসীনদের জন্য খুব একটা সহজ বলে মনে হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে তা বন্ধে দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে। এরপরও থামছে না কোনো কিছু।
বিশ্লেষকদের মতে, যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা রুদ্ধ হয়ে পড়ে, সেখানে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা বিরাজমান থাকে। কেননা, অতীতেও এমনটি লক্ষ্য করা দেখা গেছে।
আর এমনটি ঘটলে হাসিনা-খালেদা কারো জন্য শুভকর হবে না। বরং তাদের ভুলের খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হবে। ফলে আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতি আহবান রাখবো, অবিলম্বে জনগণের আকাংখা এবং দেশের সুশীলসমাজ-বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন মহলের সংলাপের আহবানকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। অন্যথা কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে কোনো পক্ষেরই যে লাভ হবে না, তা আমরা অতীত থেকেই শিক্ষা নিতে পারি। সর্বোপরি, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে শত রাজনৈতিক মতবিরোধের মধ্যেও কিছু মৌলিক প্রশ্নে সব পক্ষকে একমত হতে হবে। তবেই জাতির বৃহত্তর স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।
লেখক: ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান।
শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক।