জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল – প্রখ্যাত সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশার মহাপ্রয়াণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোকবানীর প্রেক্ষিতে এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন লন্ডন সহ ইউরোপে বসবাসরত বেশ ক’জন মুক্তিযোদ্ধা। গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্ক থেকে ফেরার পথে লন্ডনে ব্যক্তিগত সফরে যখন দু’দিন হোটেলে বিশ্রাম করছিলেন, তখন অদূরেই হাসপাতালে মুত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি স্বনামধন্য এই সাংবাদিক। সবকিছু জেনেও সেদিন আমিনুল হক বাদশাকে দেখতে যাননি বঙ্গবন্ধু কন্যা।
বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ও বিশ্বস্ত আমিনুল হক বাদশা গত প্রায় মাস ছয়েক ধরেই ছিলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সেপ্টেম্বরে লন্ডনে অবস্থানকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলেও পুরনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বশতঃ এবং ইচ্ছে করেই আমিনুল হক বাদশাকে দেখতে না যাওয়ায় তখনই লন্ডন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সমালোচিত হয় বিষয়টি। উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগে আরেক খ্যাতিমান সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী নির্মিত ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ডকুড্রামায় আমিনুল হক বাদশা তাঁর নিজের চরিত্রেই অভিনয় করেন এবং তাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেন ডায়ালগে।
‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ডকুড্রামায় আমিনুল হক বাদশা কর্তৃক ‘তুমি’ সম্বোধনে চরম ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বয়সে ছোট হয়েও সেই ক্ষোভ ধরে রাখেন তিনি কি দেশে কি বিদেশে। সেপ্টেম্বরে লন্ডনের হাসপাতালে একনজর দেখতে না যাওয়া মূলতঃ সেই ক্ষোভেরই অংশ হিসেবে জানেন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারির জীবিত নিকটজনরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদেরই একজন মঙ্গলবার এই প্রতিবেদককে বলেন, “বঙ্গবন্ধু না হোক, যদি আজ বেগম ফজিলাতুন্নেসাও জীবিত থাকতেন তবে অবশ্যই তাঁর কন্যাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন ৪৫ বছর আগে এই আমিনুল হক বাদশা যেভাবে তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিলেন”।
প্রসঙ্গতঃ পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে ব্যস্ত, বাংলার মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করাই যখন ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা, উত্তাল দিনগুলোর তেমনি একটি সময় কন্যা (শেখ হাসিনা) মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেও বাসায় ফেরার সুযোগ হয়নি বঙ্গবন্ধুর। আদরের কন্যার অসুস্থতায় বড় অসহায় বেগম ফজিলাতুন্নেসা তখন শুধু চোখের জলই ফেলতে পেরেছিলেন। ঘটনাক্রমে তখন আমিনুল হক বাদশা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হন এবং দ্রুত ব্যবস্থা করেন জরুরী সব চিকিৎসার। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই আমিনুল হক বাদশাহর জীবন-মৃত্যু যন্ত্রনার দুঃসংবাদে লন্ডনে গত সেপ্টেম্বরে একটুও মন গলেনি ‘সেদিনের অসুস্থ’ তথা ‘আজকের সুস্থ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
আমিনুল হক বাদশার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভের বিষয়টি বিলেতে বসবাসরত দলীয় নেতা-কর্মীদের জানা থাকায় তারাও তাদের প্রিয়নেত্রীর পদাংকই অনুসরণ করেছেন বিগত মাসগুলোতে। মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর সেনানী আবদুর রাজ্জাককেও অবশ্য একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল লন্ডনের হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে। ‘না ফেরার দেশে’ চলে যাবার সংবাদ প্রচারিত হবার আগ অবধি কোন কানামাছিরও সৌভাগ্য হয়নি তাঁদের খোজ খবর নেবার। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে যখন বিচ্যুত আজকের আওয়ামী লীগ, সামান্য জেদ-ক্ষোভের মতো মানবীয় দুর্বলতার কাছে যখন পরাজিত স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, তখনই অকৃতজ্ঞ এই জাতিকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে বিদায় নিলেন সবার প্রিয় ‘বাদশা ভাই’।